ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

লিটন আব্বাস

ব্রাজিলের জার্সিতে নেইমারের ‘হাফসেঞ্চুরি’

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

ব্রাজিলের জার্সিতে নেইমারের ‘হাফসেঞ্চুরি’

ফুটপাথ, সমুদ্রসৈকত কিংবা বস্তিতে খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠা। এক সময় বিশ্বসেরা তারকা বনে যাওয়া। দক্ষিণ আমেরিকার সব ফুটবলগ্রেটের ক্ষেত্রেই এর যে কোন একটি প্রযোজ্য। নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়রের উত্থানও অন্যসব ফুটবল গ্রেটদের মতোই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ আর জীবিকার তাগিদে ফুটবলকে ধ্যান-জ্ঞান ও পেশা হিসেবে বেছে নেয়া। যার ফল, নেইমার এখন বিশ্ব ফুটবল মঞ্চের মূল কুশীলব। ছোটবেলায় দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে নেইমারের বাবা ‘সিনিয়র নেইমার দ্য সিলভা’কে। ভাগ্যান্বেষণে ব্রাজিলের মধ্যাঞ্চলের শহর সাও ভিনসেন্ট থেকে ১৯৯২ সালে সাও পাওলোর মগি দাস ক্রুজেস শহরে এসেছিলেন তিনি। মনের কোণে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন লালন করে জন্মস্থান ছেড়ে এসেছিলেন সিনিয়র নেইমার। কিন্তু পারেননি ভাগ্যের চাকা সচল করতে। তাঁর পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। নিদারুণ ওই দুঃসময়ে সিনিয়র নেইমারের ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ঘর আলো করে আসে জুনিয়র নেইমার। এরপর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে যায় তার। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলেকে দিয়ে পূরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এ কারণে অভাবের সংসার হলেও ছেলেকে এর আঁচ লাগতে দেননি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উত্তরসূরির চাওয়া পূরণ করতে। ছোট্ট ছেলের প্রতিভা ক্ষুরধার হওয়ায় কাজটাও সহজ জয়। যার প্রমাণ মেলে স্থানীয় ‘পর্তুগীজা সানটিস্টা’ ফুটবলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। তখনই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ব্রাজিলের বস্তি থেকে ফুটবিশ্ব শাসন করতে আসছে আরও একজন বিস্ময়বালক। মূলত সাও পাওলোর রাস্তায় ফুটবল খেলতে খেলতে ফুটবলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় সেদিনের ছোট্ট নেইমারের। আর তার পরিণতিটা নিয়মিতভাবে দেখেছে ফটবল দুনিয়া। নেইমারের বিস্ময়কর উত্থানের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর তিনি কিশোর প্রতিভা হিসেবে কিংবদন্তি পেলের সাবেক ক্লাব সান্তোসে যোগ দেন। পেশাদার ফুটবলের সঙ্গে তখন থেকেই পরিচিতি ব্রাজিলের বর্তমান স্বপ্নদ্রষ্টার। ফলস্বরূপ অল্প সময়ের মধ্যেই নেইমারের সংসারের অভাব বিতাড়িত হয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের মালিক বনে যায় নেইমারের পরিবার। এরপর প্রত্যাশিতভাবেই নাম লেখান সান্তোসের মূল দলে। ফলাফল কি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! ধারাবাহিক বিস্ফোরক পারফরমেন্স প্রদর্শন করে নেইমার এখন বর্তমন বিশ্ব ফুটবলের সেরা তারকাদের একজন। সঙ্গতকারণেই অর্থের ঝনঝনানির সঙ্গে নিত্য বসবাস নেইমার ও তার পরিবারের। টগবগে তারুণ্য। এখনই সময় সবকিছু জয় করার। নেইমার তেমনই করে চলেছেন। ফুল হয়ে ফোটার আগেই ছড়িছে চলেছেন সুগন্ধ। আর তাতেই বিশ্ব বুদ। ২৪ বছর বয়সী এই প্রাণচাঞ্চল তরুণ ২০১৩ সালে নবম ফিফা কনফেডারেশন্স কাপে আরেকবার চেনান নিজের জাত। বিশ্বের বাঘা বাঘা ফুটবলারদের পেছনে ফেলে আসরের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন। নিজ দেশ ব্রাজিলকে ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ে কারিগরের ভূমিকা পালন করেন। এসব সম্ভব হয়েছে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, পায়ের কারুকাজ, মাঝ মাঠে গতির ঝড়, আচমকা আক্রমণে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে গুড়িয়ে দেয়ার কারণে। দুর্দান্ত এই পারফরমেন্স দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও ক্ষুরধার হয়েছে। যার প্রমাণ বর্তমান ক্লাব বার্সিলোনা ও জাতীয় দল ব্রাজিলের হয়ে দেখা যাচ্ছে। সাহসী এই যুবার পারফরমেন্স এমন যে, মনে হয় তিনি একাই একশ! সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ক্লাব ফুটবলে লিওনেল মেসির ছায়া থেকে ক্রমশই নিজেকে সরিয়ে আনছেন নেইমার। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাজিলিয়ান তারকার দুর্দান্ত পারফরমেন্সই এমন সাক্ষ্য দিচ্ছে। এটা ঠিক রেকর্ড টানা চারবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের সঙ্গে খেলে নেইমার সত্যিই নিজেকে অনেক পরিণত করেছেন। মাঠে মেসির সঙ্গে তাঁর দারুণ বোঝাপড়া। মাঠের বাইরেও দুজনের সম্পর্ক অনেক ভাল। তবে বার্সিলোনায় শুরু থেকেই যেন মেসির ছায়ায় ঢাকা পড়েছিলেন নেইমার। যদিও এখন অনেক ফুটবলবোদ্ধার ধারণা, ধীরে ধীরে দলের সবচেয়ে বড় তারকার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন বর্তমানে পেলের দেশের সবচেয়ে বড় তারকা। ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে চলা মেসি-রোনাল্ডোর আধিপত্যও ভেঙে দেয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন নেইমার। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোস ছেড়ে ২০১৩ সালে বার্সিলোনায় যোগ দেন নেইমার। ক্যাটালান ক্লাবটিতে যোগ দেয়ার পর থেকেই নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেন তিনি। প্রতি বছরই যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার। জাতীয় দলের জার্সিতে যেন আরও দুর্বার নেইমার। গত আগস্টে ব্রাজিলকে উপহার দিয়েছেন অলিম্পিক ফুটবলের অধরা স্বর্ণপদক। এরপর তার জাদুতেই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিলকে খাদের কিনারা থেকে তুলে এনেছেন। সবশেষ পাঁচ পর্বের ম্যাচে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা জিতেছে নেইমারের হাত ধরে। তাতেই পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে সাম্বা ছন্দের দেশ। শুধু তাই নয়, গত ১১ নবেম্বর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে গোল করে দেশের জার্সিতে ৫০ গোলের মাইফলক স্পর্শ করেছেন নেইমার। দক্ষিণ আমেরিকা বা ইউরোপের আর কারও এত কম বয়সে ৫০ গোল করার রেকর্ড নেই। মাত্র চতুর্থ ব্রাজিলিয়ান হিসেবে ৫০ গোলের কীর্তি গড়েছেন। গোলের হাফসেঞ্চুরি করতে নেইমার খেলেছেন ৭৪ ম্যাচ। এর আগে যে তিনজনের এই কীর্তি গড়েছেন তাঁরা সবাই ব্রাজিলের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। নেইমারের ঠিক সামনেই এখন ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপজয়ী তারকা রোমারিও। ৭০ ম্যাচে তাঁর গোল ৫৫টি। ৯৮ ম্যাচে ৬২ গোল নিয়ে এর পরেই আছেন ‘ফেনোমেনন’ রোনাল্ডো। আর ৯১ ম্যাচে ৭৭ গোল নিয়ে সবার ওপরে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার পেলে। কালে মানিককে ছাড়িয়ে যেতে নেইমারের দরকার আর ২৮ গোল। যে গতিতে এগিয়ে চলেছেন তাতে রোমারিও, রোনাল্ডোই শুধু নয়, পেলেকেও ছাড়িয়ে যেতে খুব বেশি সময় নেবেন না নেইমার। ২০১০ সালে অভিষেকের বছরে শুধু একটি গোল পেয়েছিলেন। এর পরের চার বছরে গোল পেয়েছেন ৪১টি। গত বছরটাই শুধু নিয়মিত খেলতে পারেননি, নয় ম্যাচে ছিল চার গোল। চলমান বছরে পাঁচ ম্যাচে করে ফেলেছেন চার গোল। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সাতটি ম্যাচ খেলেছেন করেছেন চার গোল। এভাবে চলতে থাকলে গোলের সেঞ্চুরি টাও নিশ্চয় নেইমারের কাছে অসম্ভব থাকবে না।
×