ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

চতুর্থ অধ্যায় মহামান্য ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব উদ্্যাপন (গতকালের পর) সেই ছোট বাড়িটিতেই লাট সাহেব রানীকে সংবর্ধনা জানান। ভোজটি পরিবেশনের ব্যবস্থা হয় নিকটস্থ বিরাট বাগানে। এই প্রসঙ্গে বর্তমানের বঙ্গভবন সম্বন্ধে কিছু বলা যথাযথ হবে। ১৯০৫ সালে যখন ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও অসম প্রদেশের সৃষ্টি হয় তখনই প্রাদেশিক সরকারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঘরবাড়ি বানানো হয়। বর্তমানের মেডিক্যাল কলেজ প্রাদেশিক সচিবালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। রমনা এলাকায় সুন্দর সুন্দর লাল বাড়ি এবং বর্তমানে বাংলা একাডেমির মূল বাড়ি সেগুলোও নির্মিত হয়। বাংলা একাডেমির হাউসকে বর্ধমান হাউস বলে ডাকা হয় তার কারণ হলো এই বাড়িতে প্রাদেশিক লাট সাহেবের কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা এবং তিনিই এই বাড়িতে থাকতেন। প্রাদেশিক লাট সাহেবের জন্য বর্তমানের সুপ্রীম কোর্ট এলাকায় যে পুরনো ভবনটি আছে সেইটি নির্মিত হয়। কিন্তু লাট সাহেবের স্ত্রী এই বাড়িতে কয়েকদিন থেকেই বাড়ি ছেড়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাড়িতে নাকি সন্ধ্যা থেকেই নানা ধরনের বিচিত্র আওয়াজ হতো এবং মানুষের নড়াচড়ার অনুভূতি হতো। তাই লাট সাহেবের অন্দর মহল বাড়িটিকে ভৌতিক আখড়া হিসেবে শনাক্ত করেন। তিনি গো ধরলেন যে, এই বাড়িতে থাকবেন না এবং লাট সাহেবকে পদত্যাগ করতে সাধলেন। লাট সাহেব চলে যাবেন তাতে তো নবগঠিত প্রদেশের খুব ক্ষতি হবে। তাই উচ্চ পর্যায়ের মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে ঢাকার নবাব তাদের বাগানবাড়ি দিলকুশা ভবনটি লাট সাহেবের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেন। এই দিলকুশা ভবনেই ১৯০৫-১১ সাল পর্যন্ত বাংলার লাট সাহেব বসবাস করতেন। ১৯৪৭ সালে যখন দেশ বিভাগ হলো তখন আবার এই বাড়িটিই হলো লাট ভবন। লাট ভবনে আমার যতদূর মনে পড়ে ভবন ছিল দুটি লাট ভবন এবং মানুক হাউস। ১৯৪৭ সালে তড়িঘড়ি করে লাট সাহেবের সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্য লাট ভবনের চৌহদ্দির ভেতরেই একটি বড় ধরনের কাঠের বাড়ি নির্মাণ করা হয়। সেই বাড়িতে লাট সাহেবের সচিব, সামরিক সচিব এবং ব্যক্তিগত স্টাফ বসবাস করতেন। ১৯৫৪ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে ব্যাপক ঝড়ঝঞ্ঝা এবং বন্যার সূচনা হয়। এই অবস্থাটি পরবর্তী তিন দশকব্যাপী চলতে থাকে। ১৯৬০ সালের বর্ষাকালে নিয়মিত কায়দায়ই একটি বড় ঝড়ঝঞ্ঝা এবং বন্যার দেখা দেয়। সেই উপলক্ষে সরকার ত্রাণ এবং পুনর্বাসন সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। ঢাকায় একটি কন্ট্রোলরুমও প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার দায়িত্বে ছিলাম আমি। বেশ কিছুদিন প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলা বন্যা এবং ঝড়ঝঞ্ঝা পরিস্থিতি নিয়ে লাট সাহেবের নেতৃত্বে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠক হতো। একদিন সন্ধ্যাবেলা একটি বড় ঝড়ে লাট ভবনের কাঠের এক অংশ ভেঙ্গে যায়। তার পরেই তড়িঘড়ি করে নতুন লাট ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তাই মহামান্য রানী যখন পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণে আসেন তখন তাকে লাট ভবনে রাখার কোন সুযোগই ছিল না এবং লাট ভবনে নৈশভোজের জন্য কোন হলঘরও ছিল না। রানীর ভ্রমণসূচীতে আর একটি উল্লেখযোগ্য আইটেম ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী পাটকল পরিদর্শন। সেই সময় বিদেশী গণ্যমান্য প্রত্যেক অতিথিকেই নদীমাতৃক বাংলাদেশের কিছু সময়ের জন্য হলেও নৌভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হতো। মহামান্য রানীর জন্য ব্যবস্থা হলো যে, তিনি পাগলার স্টিমারঘাটে লাট সাহেবের নৌযান মেরী এন্ডারসনে উঠবেন এবং সেখান থেকে স্টিমারযোগে আদমজী পাটকলে যাবেন। ফেরার পথে সম্ভবত তাকে গাড়ি করেই ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা ছিল। নৌভ্রমণটি সর্বদাই আরামদায়ক ছিল এবং বাংলাদেশের গ্রাম জীবনের স্বাভাবিক পরিচয় তাতে পাওয়া যেত। আমার যতদূর মনে পড়ে রানী তৃতীয় দিনে অপরারেহ্ন ঢাকা ছেড়ে চলে যান। তিনি যখন বিমানপোতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তখন ঠিক হলো যে, তার দলবল এবং আমাদের যারা তার সেবায় নিযুক্ত ছিলেন তাদের সকলকে নিয়ে একটি গ্রুপ ফটো তোলা হবে। রানীর সহযাত্রী সবাই এবং মেজবানসহ দেশের কর্মকর্তা যারা তার দেখাশোনা করেন তাদের সর্বমোট ২০-২৫ জনের একটি গ্রুপ ফটো তোলা হয়। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে সেই গ্রুপ ফটোতে আমরা মাত্র দু’জন বাঙালী ংড়হ ড়ভ ঃযব ংড়রষ ছিলামÑ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রটোকল অফিসার হিসেবে আমি। এই ছবিটি দেখেই কি ধরনের বৈষম্য পাকিস্তানে বিরাজ করত তারই একটি নিঃশব্দ পরিচয় পাওয়া যাবে। সেলিমুজ্জামানের সঙ্গে ১৯৭১ সালে মার্চ-এপ্রিলে আমার যোগাযোগ হলে তিনি উপদেশ দেন জলদি বাংলাদেশের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে পরিস্থিতি কেমন গড়াচ্ছে সেটা দেখে নেয়া ভাল হবে। তার সঙ্গে এর পর আমার আর কোন যোগাযোগ ছিল না। তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানেই চাকরিজীবন কাটাতে মনস্থ করেন। সেখান থেকে আশির দশকে অবসর নেয়ার পর তার সঙ্গে পুনরায় আমার মোলাকাত হয়। অতঃপর তার আর কোন খোঁজ পাইনি। চলবে...
×