ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. পরিতোষ কুমার দাস

সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক নাগরিকদের সমস্যা

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক নাগরিকদের সমস্যা

ঢাকা থেকে যশোর আসছি। আগে টিকেট করিনি। সকালে আসলাম একটি নামকরা পরিবহনের টিকেট কাউন্টারে। এটি পান্থপথের মোড়ে অবস্থিত। যশোরের টিকেটের কথা বললাম। কম্পিউটারে অনুসন্ধান করে কাউন্টার থেকে জানাল সাতটার চেয়ার কোচে ডি-৩ সিটটি ফাঁকা আছে। টিকেট নিলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম বাসের জন্য। নির্ধারিত সময় বাস আসল। বাসে উঠলাম। বসলাম নির্ধারিত সিটে। বাস ছাড়লো। বাস আসল কল্যাণপুর। বি-১ সিটে বসে আছেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। বাসের সুপারভাইজার জানায় এই টিকেট কয়েকদিন আগে বিক্রি করা হয়। কাউন্টার থেকে ভুল করে দেয়া হয়েছে। অতএব বয়স্ক ভদ্রলোককে বাস থেকে নামতে হবে। তখন ভদ্রলোক জানান, তার পুত্র এই বাসে উঠিয়ে দিয়ে গেছে। তিনি আসবেন মাগুরায়। তিনি বাস থেকে নামতে রাজি হলেন না। সুপারভাইজার তাকে বাস থেকে নামানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। বাসে চল্লিশ জনের ওপর যাত্রী। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করল না। শেষ পর্যন্ত আমি সুপারভাইজারকে বললাম। তোমাদের ভুল। উনি বাস থেকে নামবেন কেন? প্রয়োজনে সিট পরিবর্তন কর। আমি প্রতিবাদ করায় তখন সুপারভাইজার বাস থেকে নেমে গেল। তখন আমি ভদ্রলোককে বললাম, আপনি বাস থেকে নামবেন না। বাস আসল গাবতলী। তখন সুপারভাইজার আবার ভদ্রলোককে বাস থেকে নামার কথা বলে। সে আরও জানান, তাকে অন্য একটি বাসে উঠিয়ে দেয়া হবে। ভদ্রলোক সুপারভাইজারের কথায় নেমে গেলেন বাস থেকে। তিনি নামতে না চাইলে আমি আটকানোর চেষ্টা করতে পারতাম। যা হোক, সফল হলো না আমার চেষ্টা। তবে আমি ব্যতীত আর কেউ এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করল না। তখন মনে হলো, আমরা কি সত্যিকার অর্থে সভ্য সমাজের অধিবাসী? এক্ষণে আলোচনায় আসা যায়, ভদ্রলোক একজন সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক নাগরিক। এই বয়স্ক নাগরিক সম্পর্কে ছিল না কোন সুস্পষ্ট ধারণা। সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক নাগরিক শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতে বেড়াতে গিয়ে। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের নবেম্বর মাসে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ভারতে গেলাম বেড়ানোর উদ্দেশে। লক্ষ্য দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারী। এখান দিয়েই শুরু হবে আমার দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ। এই কন্যাকুমারী যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকেট প্রয়োজন। ট্যুরিস্টদের জন্য আলাদা টিকেটের ব্যবস্থা আছে এটি আমার জানা ছিল। কিন্তু এ টিকেটটি সংগ্রহ করতে হয় একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা। কলকাতার ফেয়ারলিপ্যালেস থেকে সংগ্রহ করতে হয় এই ট্যুরিস্ট টিকেট। আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী যিনি অবসর গ্রহণের পর ভারতে অবস্থান করছেন। তাকে নিয়ে গেলাম টিকেট সংগ্রহ করার জন্য। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে তাকে নিয়ে ট্রেনে করে পৌঁছলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। শিয়ালদহ রেলওয়ে হসপিটালে তার একজন অসুস্থ আত্মীয়ের ডাক্তার দেখাতে হবে। এ জন্যে তিনি গেলেন এই হসপিটালে। আমিও সঙ্গী হলাম তার। বেশকিছু সময় অপেক্ষা করার পর তিনি শেষ করলেন আত্মীয়ের ডাক্তার দেখানোর কর্মটি। এরপর তাকে নিয়ে পৌঁছলাম ফেয়ারলিপ্যালেসের রেলওয়ে দফতরে। ট্রেনের টিকেট প্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট আবেদনটি যথাযথভাবে পূরণ করলাম। এ অবস্থায়, টিকেট প্রাপ্তির জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। আবেদনের সঙ্গে জমা দিলাম পাসপোর্ট। টিকেট প্রদানের সময় কাউন্টার থেকে আমাকে জানান হলো আপনি ‘সিনিয়র সিটিজেন’। এই সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে টিকেটে নির্দিষ্ট ছাড় পাবেন। যতদূর মনে পড়ে টিকেটে শতকরা প্রায় চল্লিশ ভাগ ছাড় পেয়েছিলাম। প্রসঙ্গত বলা যায়, সমগ্র দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের সময় ট্রেনের টিকেটে আমি পেয়েছিলাম এই হারে ছাড়। ‘সিনিয়র সিটিজেন’ শব্দটির মাহাত্ম্য সম্পর্কে এই প্রথম অবহিত হলাম। কেবল অবহিত হলাম বললে ভুল বলা হবে। সমস্ত ভ্রমণে উপভোগ করলাম এই সিনিয়র সিটিজেনের সুবিধা। এটিই সিনিয়র সিটিজেনের বিশেষত্ব। এটি মূলত বয়স্ক নাগরিকের সম্মান। অতঃপর অতিবাহিত করলাম বেশ কয়েকটি দিন। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলাম। বন্ধু, আত্মীয়স্বজন এবং আমার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ও পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক প্রফেসর ড. গোপাল চন্দ্র খাঁ মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করে আসলাম। এ ছাড়া ভ্রমণের প্রস্তুতির জন্য লেগে গেল কয়েকটি দিন। সময় এগিয়ে আসল। উনিশ নবেম্বর, ২০১২ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার আমার দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ শুরুর দিন। কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়বে বিকেল চারটা কুড়ি মিনিটে। আমি অবস্থান করছি বারাসাত বন্ধুর বাড়িতে। বারাসাত থেকে বাস ধরে সরাসরি যাওয়া যায় হাওড়া স্টেশনে। বন্ধুর বাসা থেকে বারোটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে একটা বড় ট্রলিব্যাগ। আর হাল্কা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়েছি একটি ঘাড়ে ঝুলানো ব্যাগে। এসব নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসলাম। হাওড়া যাওয়ার নির্ধারিত বাসে উঠলাম আমার জিনিসপত্র নিয়ে। বাসে উঠে দেখলাম ড্রাইভারের সিট, অর্থাৎ যে আসনে বসে ড্রাইভার গাড়ি চালান, তার ঠিক পেছনে অবস্থিত সিটের ওপরে লেখা আছে ‘সিনিয়র সিটিজেন’। একটি আসনে দু’জন বসা যায়। লেখা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই আসনটি ‘সিনিয়র সিটিজেন’ বা বয়স্ক নাগরিকদের বসার জন্য নির্ধারিত। এই আসনের সামনে বেশকিছু ফাঁকা স্থান ছিল। সেখানে আমার ট্রলিব্যাগটি রেখে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসলাম। নির্দিষ্ট সময়ে বাস ছাড়ল। আমি চলে আসলাম ওই বাসে চড়ে হাওড়া স্টেশনে। হাওড়া স্টেশন থেকে কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস ট্রেনে গেলাম তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে। কন্যাকুমারীতে দু’দিন অবস্থান করলাম। তারপর ট্রেনে গেলাম রামেস্বরম। ট্রেনের টিকেট কেনার সময় পেলাম সিনিয়র সিটিজেনজনিত আর্থিক ছাড়। এখানে অবস্থান করলাম একদিন। এটিও তামিলনাড়ুর মধ্যে। এখান থেকে বাসযোগে গেলাম মাদুরাই। মাদুরাই অবস্থান করলাম দু’দিন। এখান থেকে ট্রেনে গেলাম কেরালার রাজধানী ত্রিবন্তপুরম। ত্রিবন্তপুরমে থাকলাম একদিন। এখান থেকে ট্রেনে গেলাম কেরালার একটি জেলা শহর কোল্লাম। কোল্লামে অবস্থান করলাম একদিন। এখান থেকে সংগ্রহ করলাম একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কোল্লাম থেকে নদীপথে গেলাম কেরালার আর একটি জেলা শহর আলাহাপুজা। একটি সুন্দর জলযান। প্রায় আট ঘণ্টা অতিবাহিত করলাম এই জলযানে। মজার ব্যাপার, এই জলযানে ছিল প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন যাত্রী। সবাই বিদেশী। ভ্রমণের সময় যতটা সম্ভব হেঁটে শহরটি দেখার চেষ্টা করেছি। এই আলাহাপুজায় রাতযাপন করেছিলাম একটি বাড়িতে। এর মাধ্যমে ছিল যে জলযানে করে কোল্লাম থেকে আলাহাপুজায় এসেছিলাম, তার চালক। বস্তুত আমি একা কেবল এখানে অবস্থান করেনি। আরও দু’জন বিদেশী অবস্থান করেছিল এই বাড়িতে। এই যোগাযোগেরও মাধ্যম ছিল জলযানের চালক। আসলে এখানে এ রকম অনেক বাড়িই ব্যবহার করা হয় আবাসিক হোটেল হিসেবে। যা জানতে পারলাম এ ধরনের বাড়িতে অবস্থান করার ফলে। এটিই এদের ব্যবসা। কয়েক বন্ধু মিলে পরিচালনা করে এই ব্যবসা। এরা সাধারণত বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে মক্কেল যোগাড় করার লক্ষ্যে। আর বিভিন্ন যানের চালকের সঙ্গে থাকে এদের যোগাযোগ। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এই সংযোগ স্থাপন প্রক্রিয়া। আবার পরের দিন বিকেলে যখন আমি কোচি যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে আসলাম, তখন যে ছেলেটি আমাকে তার স্কুটারে করে তাদের আবাসন তথা হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল, সে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে এটি অনুধাবন করতে আমার অসুবিধা হলো না। তবে এই বাড়িতে না থাকলে এ সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হতো না। যা হোক, আমার আলোচনার উদ্দেশ্য হোটেল ব্যবসা নিয়ে নয়। বস্তুত এই আলাহাপুজায় যা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তা আলোচ্য বিষয়। আসলে ভ্রমণের ক্লান্তি এবং আলাহাপুজার ওই বাড়িতে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা আসন্ন। নবেম্বর মাস, অথচ প্রচ- গরম। ওই বাড়িতে গিয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। তার পর স্নান করলাম। তখন রাত হয়েছে। নতুন ও অপরিচিত জায়গা। তাই আর ওই বাড়ি থেকে বের হলাম না। ওদের খাবারের মেন্যু কার্ড দেখে বললাম রুটি ও সবজি নিয়ে আসতে। রাতে রুটি খেয়ে গেলাম বিছানায়। খুব ভোরে উঠলাম। হাঁটার জুতা পরে বেরিয়ে পড়লাম। যেখানে ছিলাম এটি শহরতলি। এখান থেকে বেরিয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম ওই পথ ধরে পৌঁছলাম শহরে। এ একটি জেলা শহর। পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। এভাবে প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটলাম। হাঁটছি আর দেখছি। দু’পাশের দোকানগুলো। মিষ্টির প্রতি আমার ভীষণ লোভ। ভেবেছিলাম পরোটা আর মিষ্টি দিয়ে সকালের খাবার সারব। কিন্তু এ পথ ও পথ ধরে দু’ঘণ্টা হাঁটার পরও সন্ধান পেলাম না আমাদের দেশের মতো কোন মিষ্টির দোকান। বাধ্য হয়ে সকালের খাবার খাওয়ার জন্য হোটেল খুঁজতে হলো। পেটে তখন প্রচ- ক্ষুধা। হোটেলে ঢুকে দেখলাম এক ধরনের নতুন খাবার। সম্ভবত চালের গুঁড়া ও নারিকেল দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। দেখতে অনেকটা গোল আকৃতির, আমাদের তেলপিঠার মতো আকৃতির। কিন্তু ধপধপে সাদা। যাহোক ওই বস্তু চারটি খেলাম। সঙ্গে কিছুটা টক জাতীয় তরল পদার্থ। খেতে যে খুব ভাল লাগল তা বলা যাবে না। বাস্তবে ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটলÑ এটিই বড় কথা। এই হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম পুলিশ স্টেশন বা থানা। এই থানার পাশে একটি ঘর। এই ঘরের ওপরে লেখা আছে ‘সিনিয়র সিটিজেন বুথ’। এই লেখা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এই বুথে সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক নাগরিকদের সমস্যা শোনা হয়। আরও অনুধাবন করতে অসুবিধা হলো না, এখানে কেবল সমস্যা শোনা হয় না; বরং করা হয় তাদের সমস্যার সমাধান। আলাহাপুজায় প্রত্যক্ষ করলাম ‘সিনিয়র সিটিজেন বুথ’। অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয় বয়স্ক নাগরিকদের সমস্যার সমাধান। এর আলোকে যৌক্তিকভাবে অনুমিত হয় কেবল আলাহাপুজা শহরে নয়; বরং ভারতের আরও অনেক শহরে আছে এ ধরনের পরামর্শ কেন্দ্র। যেখানে করা হয় বয়স্ক নাগরিকদের সমস্যার সমাধান। পুলিশ যে জনগণের বন্ধু, তা প্রমাণ করে এই সেবা প্রদানের ভেতর দিয়ে। এই আলাহাপুজায় দেখবার মতো তেমন কিছু ছিল না। তাই একদিন অবস্থান করার পর এখান থেকে কেরালার অপর একটি জেলা শহর কোচিতে। এই কোচি ভারতের একটি সমৃদ্ধ বন্দর শহর। ব্রিটিশ ভারতের সময় থেকেই এই কোচি একটি সমৃদ্ধ সমুদ্র বন্দর। ভাসকোদাগামা এসেছিলেন বাণিজ্য করার উদ্দেশে এই কোচি শহরে। এখানেই হয় তাঁর জীবনাবসান। এই কোচির মাটিতে তার সমাধি। এই সমাধিকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয়েছে একটি গির্জা। এই গির্জাটি একটি নির্জন স্থানে অবস্থিত, যা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তবে শোনা যায়, তার সুযোগ্য পুত্র পিতার এই সমাধি থেকে দেহাবশেষ নিয়ে গেছেন নিজ দেশে এবং সেখানেই দেয়া হয় তার সমাধি। এটিই পিতার প্রতি পুত্রের শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা। কোচি শহরে অবস্থান করলাম দু’দিন। এখান থেকে সুযোগ পেলাম লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের। এটি ভারতের একটি দ্বীপরাজ্য। এ একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। আরব সাগরের পরিম-লে এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান। কোচি শহর থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান প্রায় চার শ’ কিলোমিটারের মতো। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছত্রিশটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয় দ্বীপরাজ্য। এই ছত্রিশটি দ্বীপের আয়তন বত্রিশ বর্গকিলোমিটার। সব থেকে বড় দ্বীপটির আয়তন চার বর্গকিলোমিটারের মতো। ডিসেম্বরের দুই তারিখে বিকেল তিনটায় কোচি থেকে জাহাজ ছাড়ল। পরের দিন ভোরে পৌঁছলাম লাক্ষাদ্বীপের রাজধানী কোবারতিদ্বীপে। সমস্ত দিন অবস্থান করলাম এই দ্বীপে। বিকেল পাঁচটায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় মূল জাহাজে। রাতযাপন করলাম এই জাহাজে। পরের দিন সকালে গেলাম মিনিকয় দ্বীপে। এখানেও থাকলাম সমস্ত দিন। বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় জাহাজে। এখান থেকে ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখ সকাল আটটায় চলে আসলাম কোচি বন্দরে। সমাপ্তি ঘটল নৈসর্গিক দৃশ্যাবলীর। সমন্বয়ে গঠিত লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের। এই এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা, যা ভাষা প্রকাশ করা সহজতর নয়। এ এক নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী। এই দৃশ্যাবলী বর্ণনা করা যায় না, যা কেবল উপভোগ করা যায় মাত্র। ট্রেনের টিকেট কাটা ছিল। ওই দিন রাতে চলে আসলাম চেন্নাই। চেন্নাই থাকলাম দু’দিন। এখান থেকে বাসযোগে গেলাম প-িচেরি। দু’পাশে সমুদ্র। আর মাঝখান দিয়ে গেছে বিরাট রাস্তা। চেন্নাই থেকে ট্রেনেও আসা যায় প-িচেরি। কিন্তু বাসে আসলে দু’পাশের সুন্দর দৃশ্যাবলী অবলোকন করতে করতে আসা যায়। দূর হয় যাত্রার একঘেয়েমি। এই প-িচেরিতে অবস্থান করলাম তিনদিন। ঋষি অরবিন্দু প্রতিষ্ঠিত আশ্রম। বছরের সব সময় এখানে বিরাজ করে বসন্ত। ডিসেম্বর মাসে দেখলাম আম গাছে কাঁচা আম। মাত্র কুড়ি টাকায় তিনবার আহারের ব্যবস্থা। আমিষ নয়। নিরামিষ। তবে নির্ধারিত সময় আহারের জন্য উপস্থিত থাকতে হবে। নিয়ম অনেকটাই কড়াকড়ি। শুনেছি নিজস্ব খামার থেকে এখানকার খাবার আসে। প্রতিদিন প্রায় হাজার মানুষের আহারের ব্যবস্থা হয়। এসব কিছু প্রত্যক্ষ করে হয়েছিলাম বিমোহিত। প-িচেরি থেকে বাসযোগে আসলাম ব্যাঙ্গোলুরু, যা এখন ব্যাঙ্গালুরু নামে পরিচিত। এখানে দু’দিন অবস্থান করলাম। অতঃপর প্রায় এক মাস পরে ফিরে আসলাম কলতায়। হাওড়া স্টেশনে নামলাম। আবার হাওড়া থেকে বারাসাত আসার বাসে উঠলাম। বাসে ভিড় ছিল। কিন্তু ‘সিনিয়র সিটিজেন’-এর সুযোগ পেলাম। কারণ যাত্রীরা অনেকটাই সচেতন। কেউ বসলেও বয়স্ক ব্যক্তি আসলেই সিট ছেড়ে দেয়। এটিই বয়স্ক নাগরিক হিসেবে তাঁদের প্রাপ্য। কারণ এ সম্পর্কিত আছে সরকারী নির্দেশনা। পক্ষান্তরে, আমাদের দেশের বয়স্ক নাগরিক তথা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ভাগ্যে কি জোটে, তা এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। অবশ্য এই সিনিয়র সিটিজেনদের অধিকার প্রাপ্তির জন্য নেয়া হয়েছে কি তেমন কোন ধরনের উদ্যোগ? এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আছে কি তেমন কোন অবকাশ? আমরা বয়স্ক নাগরিক তথা সিনিয়র সিটিজেনরা প্রায়শই হয়ে থাকি সমস্যার সম্মুখীন। বিধায় এটি ভেবে দেখা ও সমস্যাটি চিহ্নিত করা এবং এর সমাধান সম্পর্কিত যথাযথ উদ্যোগ নেয়া যায় কি না, তার বিবেচনা করবেন পাঠকরা। এটি বয়স্কদের সমস্যা। এর সমাধান-সূত্র ও উদ্ভাবন করতে হবে বয়স্কদের। এ জন্যই উপস্থাপিত হলো সমস্যাটি। আসলে বয়স্ক নাগরিকদের সমস্যা উত্থাপন করার সময় ভ্রমণের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়। এর একটাই কারণ, বয়স্ক নাগরিকরা বাড়িতে বসে থাকলে পড়তে হয় না কোন ধরনের সমস্যায়। বাড়িতে হাঁটাচলা করেই সময়ক্ষেপণ করা যায়। কিন্তু বাইরে বেরুলেই অতিক্রম করতে হয় নির্দিষ্ট দূরত্ব। আর এই দূরত্ব অতিক্রম হেঁটে করা সম্ভব হয় না। তখন উঠতে হয় যানবাহনে। তখনই হয় সমস্যা। একজন যুবক সাধারণ শক্তি-সামর্থ্যরে অধিকারী হয়। তার পক্ষে ভিড়ে ঠাসা বাসে অধিক সময় দাঁড়িয়ে থাকা তেমন কষ্টকর হয় না। কিন্তু একজন বয়স্ক নাগরিকের পক্ষে ভিড়ে ঠাসা বাসে অধিক সময় দাঁড়িয়ে থাকা ভীষণ কষ্টকর। আরও একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করা যেতে পারে। চিকিৎসার জন্য অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পশ্চিমবাংলায় গিয়েছিলাম। প্রায় চার বছর পরে গেলাম ভারতে। যানবাহনে উঠে দেখলাম বয়স্ক নাগরিক তথা সিনিয়র সিটিজেনদের বসার জন্য নির্ধারিত স্থান। মেট্রো এবং মিনিবাসেও আছে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বসবার নির্ধারিত স্থান। এ কারণে সিনিয়র সিটিজেনদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সময় পড়তে হয় না তেমন কোন সমস্যায়। একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে এ আলোচনা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ এবং ওষুধ নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসছি। বারাসাত থেকে বেশকিছুটা তাড়াতাড়ি করেই ট্রেনে উঠলাম। বেশ ক্লান্তি লাগছিল। দাঁড়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন সময় এক ভদ্রমহিলা তাঁর আসন ছেড়ে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। ধন্যবাদ জানিয়ে তার ছেড়ে দেয়া আসনে বসলাম। তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন। আরও পাঁচ-ছয়টি স্টেশন পরে তিনি নামলেন ট্রেন থেকে। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, পারস্পরিক সহমর্মিতা থাকলে অনেক সময় সহজ হয় পথচলা। প্রসঙ্গত বলা যায়, যাদের কাছে এ সমস্যা সমাধানের জন্য উপস্থাপন করা হবে, তারাও প্রবহমানকালের প্রবাহে আসবেন এই বয়স্কদের কাতারে। মানুষের জন্য এ একটি চিরন্তন সমস্যা। কারণ, মানুষের জীবন ধারায় আছে জন্ম-মৃত্যু। জীবনের একটি সুনির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত করার পর প্রতিটি মানুষকে উপনীত হতে হয় বয়স্কদের পর্যায়ে। এটি মানুষের জন্য চরম ও পরম সত্য। আরও বলা যায়, এটি বার্ধক্যজনিত সমস্যা। তবে এখানে একটি প্রশ্ন উপেক্ষিত থাকতে পারে না, এটি মানব জীবনের চিরন্তন সমস্যা ঠিকই; কিন্তু এই সমস্যার সমাধান সূত্র নিহিত কোথায়? যা পরবর্তী সময়ে হতে পারে বিস্তারিত আলোচনার বিষয়বস্তু। সর্বোপরি, আমরা সমন্বিতভাবে কি উদ্যোগ নিতে পারি না, আমাদের বার্ধক্যজনিত কারণে উদ্ভূত এই সমস্যার যথাযথ সমাধানকল্পে? লেখক : অধ্যক্ষ (অবসরপ্রাপ্ত) সরকারী টিটি কলেজ, যশোর
×