ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুর রহমান স্বপন

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ বাঙালীর গর্ব বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ বাঙালীর গর্ব বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু

বিংশ শতাব্দীতে বঙ্গমাতার ক্রোড়ে যে সমস্ত মহাপুরুষ বাঙালী জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন, যাদের জন্য বাঙালী আজ বিশ্বসভায় গৌরবের উচ্চ আসন লাভ করেছে, বিজ্ঞানাচার্য স্যার জগদীশচন্দ্র তাদের অন্যতম। অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ শহরে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নবেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার বাবা ভগবানচন্দ্র ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার পিতৃপুরুষের আদি নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। বাবা ভগবানচন্দ্র পরে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। পুত্রের শিক্ষাবিধানের দিকে তার মনোযোগের কমতি ছিল না। মা ছিলেন নিষ্ঠাবান ¯েœহময়ী। তখনকার দিনে ব্রাহ্মসমাজের ব্যক্তিরা ইংরেজী শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আদর্শবাদী শিক্ষাবিদ ভগবানচন্দ্র বালক জগদীশচন্দ্রকে ইংরেজী স্কুলে ভর্তি না করে গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। এর কারণ প্রথমত. ছেলেকে বাংলা মাধ্যমে পড়ানো। দ্বিতীয়ত. গ্রাম্য পাঠশালায় পড়লে সে নানা শ্রেণীর ছেলেদের সঙ্গে মিশবার সুযোগ পাবে। ভগবানচন্দ্র অনুভব করতেন চাষী, জেলে, কামার-কুমার প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ছেলেদের সঙ্গে ধনীর ছেলেরা যদি না পড়ে তাহলে তারা সভ্য ও উন্নতমনস্ক হতে পারবে না। তথাকথিত ‘অস্পৃশ্য’ বালকদের সঙ্গে এক সঙ্গে বসে বাল্যকালে পড়ার কারণেই জগদীশচন্দ্র উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। পাঠশালায় জগদীশচন্দ্রের একপাশে বসত তার পিতার মুসলমান চাপরাসির ছেলে আর একপাশে বসত এক জেলের ছেলে। এই দুই বন্ধুর সঙ্গে মিশে বাল্যকালে জগদীশচন্দ্র বহু গাছপালার সঙ্গে পরিচিত হন। বাড়ি ফিরে তিনি বাবাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলতেন। দিনের বেলা সূর্য ওঠে কেন? গাছপালার প্রাণ আছে কী-না? পশুপাখির ভাষা আছে কী-না? রাতে সূর্য কোথায় যায়? বাবা ভগবানচন্দ্র এতে বিরক্ত না হয়ে পুত্রের সব প্রশ্নের সমাধান করে দিতেন সহজ সরলভাবে। পাঠশালার পর জগদীশচন্দ্র যখন বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন তখন তার মা প্রত্যেক বালককে যতœ সহকারে খাওয়াতেন। কে কোন জাতের ছেলে এসব কখনও তা তার মনে উদয় হয়নি। এই অবহেলিত ও সাধারণ ঘরের ছেলেদের সংস্পর্শে এসে এবং পিতা-মাতার আদর্শে পালিত হয়ে জগদীশচন্দ্র ছেলেবেলা থেকেই নিজের মাতৃভূমিকে চিনতে ও ভালবাসতে শিখলেন। ভগবানচন্দ্র বর্ধমানে বদলি হয়ে যান ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে। তখন জগদীশচন্দ্রের বয়স দশ বছর। তাকে ভর্তি করা হয় কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। তিনি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে উক্ত স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে একই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে এফ এ এবং ১৮৮০-তে বিএ পাস করেন। সেন্ট জেভিয়ার্সের শিক্ষক অধ্যাপক ফাদার লাফোঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে তিনি বিলেতে পড়তে যান। ইংল্যান্ডে তিনি ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়া ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি সুস্থ হয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বিজ্ঞানে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। একই সঙ্গে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লর্ড র‌্যালে এবং উদ্ভিদ-তত্ত্বের অধ্যাপক ভাইনসের প্রতিও বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুযোগ নেন। তখন কলেজে ল্যাবরেটরি ছিল না। যন্ত্রপাতির সঙ্কট ছিল। জগদীশচন্দ্র নিজের খরচে দেশী মিস্ত্রী দিয়ে যন্ত্রপাতি তৈরি করে গবেষণা করতে শুরু করেন। সেটাই ছিল তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রথম কেন্দ্র। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেশ ক’টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখেন। জগদীশচন্দ্রের আত্মমর্যাদাজ্ঞান ছিল প্রখর। তখনকার শিক্ষা বিভাগে দু’রকমের চাকরি ছিল। ইম্পেরিয়াল ও প্রভিন্সিয়াল সার্ভিস। ইম্পেরিয়াল সার্ভিস ছিল প্রভিন্সিয়াল সার্ভিস থেকে অনেক উন্নত। পদ, মর্যাদা ও বেতনের দিক থেকে অনেক ভাল। জগদীশচন্দ্রের বিলেতের ডিগ্রী এবং লর্ড রিপনের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও বাংলা শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা তাকে প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে বলেন। তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইম্পেরিয়াল সার্ভিসের এক অদ্ভুত শর্ত ছিল। যেহেতু তিনি ভারতীয় তাই বিলেতে শিক্ষার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ইংরেজদের আইন অনুসারে দুই-তৃতীয়াংশ বেতন পাবেন। তিনি এমন অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তিন বছর বিনা বেতনে অধ্যাপনার কাজ করেন। এই তিন বছর তাকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়। তখন বিবাহিত জগদীশচন্দ্র বসবাস করতেন কলকাতা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী চন্দন নগরে। সেখান থেকেই কলেজে যাতায়াত করতেন। পরে সরকার বাধ্য হয়েই তার তিন বছরের বেতনের পাওনা এক সঙ্গে পরিশোধ করে। তিনি টাকা পেয়ে বাবার ঋণ পরিশোধ করেন। এই বছর (১৮৯৫ খ্রি.) তিনি ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’ পত্রিকায় ‘ঞযব ঢ়ড়ষড়ৎরংধঃরড়হ ড়ভ ঊষবপঃৎরপ জধু ঃড় ধ ঈৎুংঃধষ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর পর ‘উবঃবৎসরহধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ওহফরপবং ড়ভ ঊষবপঃৎরপ জবভৎধপঃরড়হ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর পরেই রয়্যাল সোসাইটি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তখন রয়্যাল সোসাইটির মাসিক মুখপত্রে কোন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়া অত্যন্ত গৌরবের বিষয় বলে বিবেচিত হতো। সোসাইটি জগদীশচন্দ্রকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য অর্থ সহায়তা দেয়। এই দেখে বাংলার ব্রিটিশ গবর্নমেন্টও জগদীশচন্দ্রকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তার আরও একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ সোসাইটির পত্রে প্রকাশিত হলে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ (ডিএসসি) উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির আমন্ত্রণে তিনি তিনবার তার আবিষ্কার সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্যারেড, ডেভিডসহ বড় বড় বিজ্ঞানীর উপস্থিততে যুবক বাঙালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র তার নতুন নতুন আবিষ্কারের ওপর বক্তৃতা দেন। তিনি জার্মানের সারবোন বিশ্ববিদ্যালয়েও বক্তৃতা দেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার গবর্নর ছোট লাট স্যার উডবার্ন ও ভারত সরকার তাকে ভারতবর্ষের প্রতিনিধি করে প্যারিসের বিজ্ঞান সম্মেলনে পাঠান। সেখানে তিনি মূল্যবান বক্তৃতা প্রদান করে যোগ্যতার পরিচয় দেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদীশচন্দ্রকে অভ্যর্থনা এবং উৎসাহ দিতে তার বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। তখন থেকেই তাদের অটুট বন্ধুত্বের শুরু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জমিদারি দেখাশোনার জন্য শিলাইদহে অবস্থান করেন তখন জগদীশচন্দ্র বসু এবং তার স্ত্রী অবলা বসু মাঝে-মধ্যেই শিলাইদহে এসে অবস্থান করতেন। রবীন্দ্রনাথ এবং জগদীশচন্দ্র সাহিত্য এবং বিজ্ঞান বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন। স্যার জগদীশচন্দ্র আবিষ্কার করে প্রমাণ করেছেন, বৃক্ষের জীবন এবং মানুষের জীবনের অনেক মিল আছে। তিনি আরও আবিস্কার করেন, বৃক্ষরা রাতে নিদ্রা যায় এবং সকালে জেগে ওঠে। মৃত্যুকালে মানুষের মতো বৃক্ষরাও অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে। ড. বসুর এই আবিষ্কারে বিজ্ঞানীগণ স্তম্ভিত হন। লজ্জাবতী লতার সংবেদনশীল স্বভাবের মধ্যেই একদিন তিনি প্রাণিজ অনুভূতির ইঙ্গিত উপলব্ধি করেছিলেন। প্রাণিদেহের যে অংশ স্পর্শ করলে যেমন সেই অনুভূতি সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুর মধ্য দিয়ে তার মস্তিষ্কে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং প্রয়োজনে সাড়া দেয়, তেমনি বাইরের আঘাত উদ্ভিদদেহে যে সাড়া দেয়, লজ্জাবতী লতার মধ্যেই তা দেখতে পাওয়া যায়। জগদীশচন্দ্র ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হিসেবে মনোনীত হন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন। জগদীশচন্দ্র ভ্রমণ করতে পছন্দ করতেন। তিনি ইউরোপ-আমেরিকাসহ এশিয়ার বহু দেশ ভ্রমণ করেন। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ করেন। ৭৯ বছর বয়সে তার স্বাস্থ্যহানি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে তৎকালীন বিহার এবং বর্তমানের ঝাড়খ- রাজ্যের স্বাস্থ্যকর স্থান গিরিডি যান। ১৯৩৭-এর ২৩ নভেম্বর সেখানেই মহান এই বাঙালীর মৃত্যু হয়। [email protected]
×