ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ

ছোটবেলা যখন নিজে স্কুলে যেতাম তখন থেকেই ভাবতাম সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চারা কীভাবে স্কুলে যাবে? একবার কিছু বাচ্চাকে রাস্তায় পাতা কুড়াতে দেখে তাদের বললাম আমিও তোমাদের সঙ্গে খেলব, আমাকে নেবে তোমাদের সঙ্গে খেলতে? তখন বাচ্চাগুলো আমাকে উত্তরে বলল, আমরা তো খেলছি না আমরা পাতা কুড়াচ্ছি এগুলো বিক্রি করে আমরা ভাত খাব। তখন ঐ বাচ্চাদের কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম এ রকম কত লাখ শিশু রাস্তায় পাতা কুড়াচ্ছে! যেখানে ওদের এখন স্কুলে যাওয়ার কথা, ঠিক ঐ মুহূর্তের চিন্তাটাই আমাকে জাগো ফাউন্ডেশন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। বন্ধুরা বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় করভি রাখসান্দ ধ্রুব। জন্ম এক বিত্তবান পরিবারে। অথচ সেই পরিবারের সন্তান হয়েও ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় বস্তিতে দরিদ্র শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘জাগো ফাউন্ডেশন। ২০০৭ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু“করে জাগো ফাউন্ডেশনের। বয়স যখন মাত্র ২১ বছর। তখন রায়ের বাজার বস্তিতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ১৭ শিশুকে নিয়ে শুরু“করেন ক্লাস। আর গড়ে উঠল জাগো ফাউন্ডেশন। এ সময় নাম করা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল স্কলাস্টিকায় পড়া করভি রাখসান্দ ধ্রুবের সামনে দু’টো পথ খোলা রেখেছিলেন তার পরিবার। একটি পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নেয়া, নয়ত নিজের পথে হাঁটা। আর করভি দ্বিতীয়টিই বেছে নিয়েছিলেন। দরিদ্র শিশুদের মুখে একটু হাঁসি ফুটানোর জন্য গড়ে তুলেছেন ‘জাগো ফাউন্ডেশন।’ মাত্র সাতজন ভলান্টিয়ার ও সতেরজন সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়ে জাগোর পথচলা শুরু। সেই পথ চলার সঙ্গী এখন অনেক। বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সহায়তায় রায়েরবাজারে জাগো স্কুলের প্রথম ভবনটা গড়ে তোলা হয়। সবার সহায়তায় শিক্ষার্থীদের ফ্রী শিক্ষা উপকরণও দেয়া হয়। দিনে দিনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, অনেকেই সহয়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। এমনি করে একজন ব্যক্তি একদিন বেশ ভাল এ্যামাউন্টের টাকা ডোনেট করে। যেহেতু স্কুল ভবনও হয়ে গেছে এবং সব শিক্ষা উপকরণেরও ব্যবস্থাও করা হয়ে গেছে তাই সেই টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করা হয়। নতুন ইউনিফর্ম পেয়ে সব বাচ্চাসহ জাগো টিমের সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু সপ্তাহখানেক পড়ই তা অনেকটাই মলিন হয়ে যায় কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নোংরা ইউনিফর্ম পরে আসতে শুরু করে। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ওরা দু’বেলা ঠিকমতো ভাতই খেতে পারে না, ইউনিফর্ম পরিষ্কার রাখার সাবান কোথায় পাবে? এই সমস্যার সমাধানে ভলান্টিয়ারদের সহযোগিতাই বাচ্চাদের ইউনিফর্ম পরিষ্কার রাখার জন্য সাবানের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর থেকে ওদের নিয়মিত সাবান দেয়া হয়। জাগোর কার্যক্রম ভালই চলতে থাকে, এভাবে একটা বছর কেটে যায়। কিন্তু নতুন বছর শুরুর পর নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। গত বছরের চল্লিশ জন শিক্ষার্থী থেকে কমে প্রায় বিশজনে নেমে আসে অর্থাৎ প্রায় ৫০% শিক্ষার্থী হারিয়ে যায়। ওদের জন্য এতকিছু করার পরও এত কম বাচ্চাদের দেখে স্বাভাবিকভাবেই জাগো টিমের মন খারাপ হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাগো টিম অনুসন্ধান করে জানতে পারে এসব বাচ্চাদের বেশিরভাগ অভিভাবকই বাসায় কাজ করে কিংবা রিকশা চালায়। কাজ হারালে কাজের সন্ধানে এরা শহরের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। তখন প্রতিটা এলাকায় জাগোর স্কুল খোলা সম্ভব ছিল না তাই বাচ্চাদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের নিয়েও জাগো টিমকে ভাবতে হলো। ভলান্টিয়ার ও ডোনেটরদের সাহায্যেই সেলাই মেশিন কিনে একটা ট্রেনিং সেন্টার চালু করা হয়, সেখানে বাচ্চাদের মায়েদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শুরু“হলো জাগোর আরেকটা নতুন প্রোজেক্ট। সেই ট্রেনিং সেন্টারটাই এখন একটা বড় ফ্যাশন হাউসে পরিণত হয়েছে যার নাম হলো ‘বাচ্চারা’। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ কর্মসূচিতে আমন্ত্রিত হন করভি রাখসান্দ ধ্রুব। সে বছরই ইংল্যান্ডের মোসাইক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। জাগো ফাউন্ডেশনের ভলান্টিয়ার শাখা, ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ, ২০১১ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই সংস্থাটি মার্কিন দূতাবাস দ্বারা সমর্থিত। এই শাখাটি বাংলাদেশের যুব সমাজের একটি প্লাটফর্ম, যেখানে দেশের যুবকরা তাদের দেশের জন্য কাজ করতে পারে। ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দেশব্যাপী সংগঠন যেখানে তারা নিজেদের সমাজ ও সমগ্র দেশের জন্য কাজ করতে পারে। বর্তমানে ৩২টি ডিস্ট্রিকে ২০ হাজারের বেশি ভলান্টিয়ার তাদের কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন। ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানসমূহ হলো টহরাবৎংধষ ঈযরষফৎবহ’ং উধু, এৎবধঃ ডধঃবৎ ঈযধষষবহমব, ডড়ৎষফ ঊহারৎড়হসবহঃ উধু, এৎবধঃ করহফহবংং ঈযধষষবহমব, ঝযড়ঢ়হবৎ ঝযড়রংযড়ন, গু জড়ধফ গু ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু, ণড়ঁঃয চবৎপবঢ়ঃরড়হ ঝঁৎাবু তবে ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের একটি অসঙ্গতি চোখে পড়ার মতো, বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলে ও এর ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায় সর্বত্র ইংরেজীর প্রয়োগ। আর আমাদের বাংলা ভাষার যেখানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সেখানে ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের মতো প্রতিষ্ঠানে সর্বত্র ইংরেজীর প্রয়োগ মেনে নেয়া যায় না। এ ব্যাপারে ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত একজন কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন- এই প্রতিষ্ঠানটি বাইরের ডোনেশনে চলে তাই এই পেজটি ইংরেজীতে আর এর ওয়েবসাইটটি ভিজিটর বেশির ভাগই বুঝি দেশের বাইরের। তবে কথা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীগোষ্ঠীর তরুণদের টার্গেট করে যদি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানো হয় তবে প্রান্তিক পর্যায়ের যুব সমাজ কীভাবে এতে সম্পৃক্ত হবে তা ভেবে দেখার বিষয় আছে।
×