ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তাহেরা বেগম জলি

মহান ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মহাপ্রয়াণ

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

মহান ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মহাপ্রয়াণ

সমাজতান্ত্রিক কিউবার মহান নেতা, সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের মহান বন্ধু, ফিদেল ক্যাস্ট্রো আর নেই। তাঁর বিরুদ্ধে, মার্কিনীদের শত শত হত্যা অভিযান ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন যিনি, তিনি আজ অন্তিম শয়ানে। নিষ্ঠুর বাতিস্তা সরকারের কবল থেকে কিউবাকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন দীর্ঘদেহী এক যুবক। এবং তিনি তা পেরেছিলেন। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবাকে তিনি পরিণত করেছিলেন জনতার অভয়ারণ্যে। স্বপ্ন দেখেছিলেন- জনতার দুঃখ তাঁর বসবাসের সঙ্গী হবে না। তাই ব্যক্তি জীবনের সমস্ত প্রতিষ্ঠাকে উপেক্ষা করে, মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মার্কিন মিত্র বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর লড়াইয়ের ইতিহাস খুব-ই রোমাঞ্চকর। ইতোমধ্যে তাঁর সঙ্গে এসে মিলেছেন আর্জেন্টাইন যুবক চে গুয়েভারা। দুর্গম কিউবার মুক্তি সংগ্রামের কৌশল ছিল গেরিলা যুদ্ধ। সহযোদ্ধা চে গুয়েভারাসহ সেই মহা দুর্গম পথ পাড়ি দিলেন অকুতোভয় ফিদেল ক্যাস্ট্রো। আঘাত হানলেন বাতিস্তা দুর্গে। সঙ্গে বিশ্বস্ত রোমাঞ্চকর সৈনিক চে গুয়েভারা। যৌবনের শক্তি যে কি পরিমাণ দুর্দমনীয় হয়ে উঠতে পারে, এবার তা দেখল গোটা বিশ্ব। ফিদেল ক্যাস্ট্রো হয়ে উঠলেন গোটা দুনিয়ার স্বপ্নের মানুষ। তিনি সারা দুনিয়ার যুব শক্তিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, অন্যায় রুখে দাঁড়াতে। আরও বলেছিলেন যৌবনের মন্দিরে ভোগের কোন ঠাঁই নেই। সভ্যতাবিরোধী শক্তি ভোগের বদ্ধ জলাশয়ে যৌবনকে ডুবিয়ে মারতে চায়। কারণ অপ্রতিরোধ্য এই শক্তি-ই, দস্যু সম্প্রদায়ের রোষানল থেকে বার বার ফিরিয়ে এনেছে বিপদগ্রস্ত মানুষকে। যৌবনের সহজাত শক্তিকে পৃথিবীর কোন পরাশক্তি চোখ রাঙিয়ে রুখতে পেরেছে, এ নজির নেই। দরকার শুধু সেই শক্তিকে সঠিক ধারায় প্রবাহিত করার মন্ত্র। সেই মহান দায়িত্ব নিয়ে দুনিয়ার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন মনুষ্যত্বের পতাকাবাহী ফিদেল ক্যাস্ট্রো। বললেন মরো অথবা মারো নয়! মারো এবং মারো। লাঞ্ছিত মনুষ্যত্ব এবং যৌবনের মহাশক্তি এক-ই সঙ্গে বসবাস করতে পারে না। বড় কিছু চাইলে তার প্রতিদানটা-ও দিতে হয় বড়। এখানে আপস রফার কোন সুযোগ নেই। এক-ই সঙ্গে মানুষ এবং দানবের বসবাস হয় না। আজ তিনি নেই। মহা মানবের এ বড় গৌরবের বিদায়। এমন সফল প্রস্থান খুব কম মানুষের জীবনেই ঘটে। নিজের দেশের জন্য রেখে গেছেন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক মহৎ দৃষ্টান্ত। মানুষ কেন শিক্ষাহীন থাকবে? বিনা চিকিৎসায় কোন মানুষের একটা রাত্রিও যেন পার না করতে হয়- নিজের এই পণ, তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন কিউবায়। তিনি প্রমাণ করেছেন মানুষের জন্য সমাজ সমাজের জন্য মানুষ নয়। মানুষের মনন জগতে সুকোমল প্রবৃত্তি জাগরণের প্রয়োজনও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। কারণ পাশবিক প্রবৃত্তি দমনের অন্যতম হাতিয়ার সুকোমল প্রবৃত্তি। সারা দুনিয়ার সেরা মানবতাবাদীদের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন প্রাণের বন্ধন। নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া ছিলেন ক্যাস্ট্রোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দিয়েগো ম্যারাডোনা যে আজ মানবতার দুশমন সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, তা ক্যাস্ট্রোর-ই অবদান। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক-তাঁর সমস্ত শক্তি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দুনিয়ার দেশে দেশে। ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জনতার সংগ্রামে, সরাসরি পাঠিয়েছেন সামরিক শক্তি। এবং তা মার্কিন মুলুকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই। প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন সারা দুনিয়ার বিপ্লবী শক্তিকে তিনি প্রশিক্ষিত করে তুলতে চান। একদিকে কিউবার চারদিকে গড়ে তুলেছিলেন দুর্ভেদ্য প্রাচীর, অন্যদিকে কিউবার সংগ্রামী জনতার সঙ্গে সারা দুনিয়ার সংগ্রামী জনগণের বন্ধুত্ব স্থাপনে রেখেছিলেন অসাধারণ ভূমিকা। কিউবার ছোট্ট শিশু এলিয়ানা গঞ্জালেসকে নিয়ে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় মামলায়, এক সময় শিহরিত হয়েছিল সমস্ত পৃথিবী। যখন আমাদের সমাজে সন্তানের অসহায় মৃত্যুতে, মায়ের চোখ দিয়ে ঝরে এক বরষার জল, তখন তাবত দুনিয়া কাঁপিয়ে, ক্যাস্ট্রো ফিরিয়ে এনেছিলেন এলিয়ানা গঞ্জালেস্কে। এবং তা দুনিয়া কাঁপানো ক্ষমতাধর শক্তি মার্কিন মুলুক থেকে ছিনিয়ে। অসংখ্য রোমাঞ্চকর সাহসী কর্ম-সম্রাজ্যের অধীশ্বর ফিদেল ক্যাস্ট্রো আজ চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হবে এই মহান বিপ্লবীর কর্মচিন্তা। ফিদেল আমাদের দিয়েছিলেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সন্ধান। বড় অসহায় বোধ করে-ভাবছি, আমাদের কোন ছায়াবৃক্ষ রইল না। কখনো কখনো ব্যক্তি হয়ে ওঠে আশা ভরসার কেন্দ্রস্থল। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর এই অন্তিম শয়ান, আমাদের জন্য কি, কোন বড় দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে! আমরা ভুলে যেতে পারি না, কিউবার কাছে পাটজাত পণ্য বিক্রি করে আমরা ৫০ লাখ ডলার পেয়েছিলাম স্বাধীনতা পরবর্তী বড় দুঃসময়ে। সেই সঙ্কটকালের মহান বন্ধুর অনুপস্থিতি, আমাদের দেশের সমগ্র জনগণ, আমরা অনুভব করছি অত্যন্ত বেদনাহত মন নিয়ে। আমার মনে পড়ছে কবি গুরুর মহাপ্রয়াণে, বিদ্রোহী কবির ‘রবিহারা’র কিছু অংশ। ‘মাথার ওপরে নিত্য জ্বলিতে তুমি সূর্যের মতো, তোমারি গরবে ভাবিতে পারিনি আমরা ভাগ্যাহত। বলদর্পীর মাথার ওপরে চরণ রাখিয়া আর, রক্ষা করিবে কে এই দুর্বলের অহঙ্কার?’ লেখক : প্রয়াত কমরেড আবদুল্লাহ সরকারের সহধর্মিণী
×