ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে উদ্ধারের ঘটনা তদন্তে পুলিশ

বড় নাশকতার জন্যই অস্ত্রের মজুদ গড়ছিল জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

বড় নাশকতার জন্যই অস্ত্রের মজুদ গড়ছিল জঙ্গীরা

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর উত্তরায় কোটি টাকা বেশি মূল্যের স্মরণকালের বৃহৎ অস্ত্র-গোলাবারুদের চালান আনার সন্দেহের তীর বিএনপি-জামায়াত জঙ্গী গোষ্ঠীর দিকে। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই দেশী-বিদেশী অস্ত্র চোরাচালানের মাফিয়া চক্রের সহায়তায় অস্ত্রের চালানটি আনা হয় বলে মনে করছে তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। পুলিশের একজন উপকমিশনারের নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট গঠিত তদন্ত কমিটিও তদন্ত করছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্যসহ আশপাশে থাকা কয়েকজনের সাক্ষ্যগ্রহণ, কালো বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি ও অস্ত্রের ব্যাগ ফেলে পলায়নকারীদের খোঁজ করাসহ অস্ত্রের চালান কারা কিভাবে এনেছে তার খোঁজ করছে তদন্তকারীরা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, উত্তরা থেকে উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এনে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে মজুদ ভা-ার গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জঙ্গী গোষ্ঠী। পরিত্যক্ত অবস্থায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়েরের ভিত্তিতে মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ এই অস্ত্রের চালান কারা কিভাবে এনেছে এবং কি কারণে ওই খালে ফেলে গেছে সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্যভিত্তিক প্রমান সংগ্রহ করার কাজ এগিয়ে চলেছে। উত্তরার দিয়াবাড়ি খালে গত ১৮ মে রাতে পুলিশ তথ্য পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় দিয়াবাড়ি খালের ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৯ ফুট গভীর পানিতে তল্লাশি চালিয়ে সম্পূর্ণ নতুন অস্ত্র, গুলি, ও ম্যাগাজিনগুলো উদ্ধার করে। ১৯ জুন বিকেলে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করা হয়। পুলিশের জব্দ তালিকা অনুযায়ী ১৮ জুন উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গুলির মধ্যে ৯৫টি রয়েছে ৭ পয়েন্ট ৬২ বোরের পিস্তল, দেশীয় তৈরি ২টি পিস্তল, ৭ পয়েন্ট ৬২ পিস্তলের ম্যাগাজিন ১৯২টি, ম্যাগাজিন, পিস্তল ১০টি, এসএমজির ম্যাগাজিন ২৬৩টি, বেয়নেট ১০টি, ছোট সিলভার কালারের বক্স (যা গুলি তৈরির বক্স) ১০৪টি নাইন এমএম পিস্তলের গুলি ৮৪০ রাউন্ড, চায়না ৭ পয়েন্ট ৬২ পিস্তলের গুলি ২১৭ রাউন্ড এবং ক্লিনিং রড (অস্ত্র পরিষ্কারের কাজে ব্যবহৃত) ১৮০টি রয়েছে। ১৯ জুন উদ্ধার করা হয়েছে ৩২টি এসএমজির ম্যাগাজিন এবং ক্লিনিং রড ৮টি। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর জিডির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ ও ছয় সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটিকে। অস্ত্র-গুলি উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা জিডির তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ও দায়িত্বে আছেন অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। তদন্তে সহায়তা করছেন ডিবির ছয় সদস্যের একটি কমিটি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলতের নেতৃত্বে সদস্য সচিব হয়েছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার খন্দকার নুরুন্নবীর তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আশিকুর রহমান, মাহফুজুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা রাসেল ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার সুমিত জোয়ারদা তদন্ত করছেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশাল অস্ত্র ও গুলি কারা, কিভাবে অস্ত্রগুলো খালে আনল, কি উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে পুলিশ এটা নিশ্চিত হয়েছে যে ২০১৩ সাল থেকে যে গোষ্ঠী দেশে নাশকতা, সন্ত্রাস, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা যারা করেছে তারাই এসব অস্ত্র ও গুলি এনেছে। দেশে বড় ধরনের নাশকতার উদ্দেশ্যে অস্ত্রগুলো মজুদ করা হয়েছে অথবা আমদানি করেছে। গত ১৮ জুন সেই রাতে কালো জিপযোগ অস্ত্র ও গুলি ফেলে যায় সেখানে পুলিশের একজন কনস্টেবল তার পরিবার নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি দেখতে পান একটি কালো রঙের নম্বরবিহীন গাড়ি থেকে কিছু ব্যাগ ফেলা হচ্ছে খালে। ওই কনস্টেবল মনে করেছিলেন হয়ত কোন লাশ ফেলা হচ্ছে খালে। থানা পুলিশকে খবর দেয়া হলে তারা আসার আগেই গাড়িটি চলে যায়। এরপর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরী নামিয়ে তল্লাশি করা হলে ব্যাগগুলো উদ্ধার হয় এবং সে ব্যাগ থেকে একে একে অস্ত্র, গুলি, ম্যাগাজিন, ও পিস্তল তৈরির রড উদ্ধার হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বড় ধরনের নাশকতার জন্যই দিয়াবাড়িতে খালে অস্ত্রের মজুত করা হয়েছিল। এটা কোন সাধারণ অপরাধীদের কাজ নয়। যারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল, নারী-শিশুদের পুড়িয়ে হত্যা করেছিল এটা তাদেরই কাজ হতে পারে বলে তদন্তে প্রতীয়মান হচ্ছে। তদন্তে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব অসম) মাধ্যমে জঙ্গী গোষ্ঠীর জন্য বিএনপি-জামায়াতের সহায়তায় অস্ত্র ও গুলির মজুদ করা হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। উলফার সঙ্গে আগাগোড়াই বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোর যোগাযোগ রয়েছে এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে উলফা বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘাটি গেড়েছিল যা উৎখাত করার কারণে বর্তমান সরকারের ওপর মারাত্মক ক্ষিপ্ত ওই গোষ্ঠীগুলো। এজন্য বর্তমান সরকারকে উৎখাতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে যার বাস্তবায়ন ঘটাতে অস্ত্র ও গুলির চালান আনা হয়ে থাকতে পারে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের খালে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের পর কালো রঙের নম্বর প্লেটবিহীন একটি পাজেরো জিপ নিয়ে যে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই জিপ থেকেই খালের ভেতর ব্যাগভর্তি অস্ত্র-গুলি ফেলা হয়। তবে জিপটির মালিক কে এবং কেন খালের পানিতে অস্ত্রের ব্যাগগুলো ফেলা হয়েছে তার প্রশ্নের উত্তর মেলানো হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরায় স্মরণকালের বৃহৎ অস্ত্র ও গুলির চালান আটক হলেও এর উৎসের সন্ধানের তদন্ত অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। তদন্ত এগিয়ে চলছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে কারা কেন এগুলো এনেছে। তিনি বলেন, এসব আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। দেশের ভেতরে নাশকতা সৃষ্টির জন্য এত বড় চালান আনা হয়েছিল। পুলিশী অভিযানে ভয়ে তারা এসব ফেলে গেছে যার রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০৩ সালে বগুড়ার কাহালুতে অস্ত্র ও গুলির চালান আটক হয়। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে আটক হয় ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের চালান। ২০১৪ সালের জুন মাসে হবিগঞ্জের সাতছড়ি বনাঞ্চল থেকে র‌্যাব উদ্ধার করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকের চালান। এছাড়া শেরপুরের ঝিনাইগাতী থেকে কয়েক দফায় অস্ত্র ও গুলির চালান আটক করা হয়। ওইসব ঘটনার সঙ্গে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) জড়িত এমন প্রচার পায়। কিন্তু উত্তরায় উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গুলির উদ্ধারের পর আগের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনাগুলের অতীত উদাহরণ ও নজিরগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তের অনুসন্ধান করার কাজ চলছে। খুব সহসাই উত্তরা থেকে উদ্ধার করা সাম্প্রতিকালের বৃহৎ অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানের রহস্য উদ্ঘাটন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
×