ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নেতাকর্মীদের তোপের মুখে রওশন, এরশাদের মামলা প্রত্যাহার দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

নেতাকর্মীদের তোপের মুখে রওশন, এরশাদের মামলা প্রত্যাহার দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দলীয় নেতাকর্মীর তোপের মুখে পড়েছেন তারই সহধমির্ণী ও বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ। সোমবার রাজধানীর কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে দলের যৌথসভায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় দলের চেয়ারম্যান এরশাদসহ পার্টির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আগামী ১ জানুয়ারি পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মহাসমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে যৌথসভার আয়োজন করা হয়। এতে সারাদেশের ইউনিয়ন থেকে শুরু করে পৌরসভা, মহানগর, উপজেলা ও জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। সভায় সভাপতির বক্তব্যে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান নষ্ট হয়েছিল। এজন্য দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি মিয়ানমারে নির্যাতিত ৫০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দাবি জানান সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। বৈঠকের শুরু থেকেই তৃণমূলসহ কেন্দ্রীয় অনেকেই নেতাই আগামী নির্বাচনে কোন দল যেন ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার না করতে পারে এমন দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সভায় রওশন এরশাদ বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, আমরা কারও ক্ষমতা যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার হব না কেন? আমাদের শক্তি নেই, তাই আমরা ব্যবহার হই। শক্তি সঞ্চয় করতে না পারলে আমাদের এভাবেই থাকতে হবে। তার এ বক্তব্যের সময় পেছন থেকে নেতাকর্মীরা এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে রওশনকে কিছু বলতে বললে রওশন দেশের বেকার সমস্যা নিয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। এতে কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সেøাগান দিয়ে রওশনের বক্তব্য থামিয়ে দেন। এক পর্যায়ে আগত নেতাকর্মীরা চেয়ার থেকে উঠে সাম্প্রতিক সময়ে দলের কোন্দল, রওশনকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণাসহ নানা বিষয় উল্লেখ করে তুমুল হট্টগোল করতে থাকেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, এসএম ফয়সল চিশতি এবং যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু মাইক দিয়ে একাধিকবার শান্ত থাকতে বললেও নেতাকর্মীরা তাতে কর্ণপাত করেননি। বরং অনেক নেতা মঞ্চের সামনে এসে রওশনের উদ্দেশে বলেন, আপনারা এরশাদের জাতীয় পার্টির নাম ব্যবহার করে এমপি হবেন, সরকারের সুবিধা ভোগ করবেন অথচ এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে নিশ্চুপ থাকবেন তা হবে না। এক পর্যায়ে সংসদ থেকে বিরোধী দলের পদত্যাগ ও মন্ত্রিপরিষদ থেকে জাপার বেরিয়ে আসার দাবি জানান অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে যৌথসভা যখন দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার মাইক নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের শান্ত হবার আহবান জানিয়ে বলেন, আমাদের ম্যাডামের কথা আপনারা শুনুন। উনি সংসদে স্যারের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি তুলবেন। তার কথায় কর্মীরা কিছুটা শান্ত হলে রওশন কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের আবেগ ও দুঃখ আমি বুঝি। আমি তার (এরশাদ) মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে না হলেও এক শ’ বার বলেছি। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাহার করব করব বলেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠনের সময় প্রথম প্রস্তাব ছিল এরশাদের সকল মামলা প্রত্যাহার করা। তারা মুখে বললেও মামলা প্রত্যাহার করেনি। রওশন একপর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তোমরা তোমাদের নেতার জন্য কষ্ট পাও, কিন্তু সে তো আমার স্বামী। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে এত মামলা। আমার স্বামীর কষ্ট আমার চেয়ে আর কে বেশি বুঝবে? তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আজ এই যৌথসভায় আমি কথা দিলাম দলের চেয়ারম্যানের মামলা প্রত্যাহারের দায়িত্ব আমার। এজন্য যা যা করার প্রয়োজন হয় আমি তাই করব। উনি যখন জেলে ছিলেন তখন আপনাদের নিয়ে আমি আন্দোলন করেছি। অনশন করেছি। তখন সবাই আমার পাশে ছিলেন। সবশেষে নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি দুটি গান গেয়ে বক্তব্য শেষ করেন। জবাবে এরশাদ তার বক্তব্যে বলেন, তোমাদের ভালবাসায় আজ আমি মুগ্ধ। আমার জীবন সার্থক। তোমরা আমাকে এত ভালবাস, আমার জন্ম সার্থক। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান বিকল হওয়ার ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দাবি করে এরশাদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে যাবার সময় তার বিমান খারাপ হয়, এমন ঘটনা অতীতে আর কখনও শুনিনি। ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেছে কিনা তাও আমার জানা নেই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে বিমানে বিদেশ সফর করবেন সে বিমান বিকল হতে পারে না। উনি যদি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যেত! তখন আমাদের কি হতো। আপনি জাতির জনকের কন্যা। আপনার প্রতি ভরসা দেশের মানুষের। কিন্তু কেন এমনটা হলো! দুর্নীতি আর প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই বিমান বিকল হবার ঘটনা ঘটেছে। এদের চিহ্নিত করুন, দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। আমিও ক্ষমতায় থাকতে ৭০টি দেশে ভ্রমণ করেছি। কোনদিন এমন ঘটনা ঘটেনি। এরশাদ বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কিভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে। অথচ বিশ্ববিবেক আজ চুপ। কিন্তু আমরা নীরব থাকতে পারি না। আমরা মুসলমান। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, আপনি অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিন। ওদের বাঁচান। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষ আছে। না হয় আরও ৫০ লাখ লোক বাড়ল। নিজের স্ত্রী সম্পর্কে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আমার স্ত্রীকে বিনা দোষে তিন বছর কারাগারে রেখেছিল। সঙ্গে মাসুম শিশুটিও ছিল। ডিভিশন চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু দেয়া হয়নি। জেলে থাকার কারণে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে পরিনি। যথাসময়ে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি বলে ভাল স্কুলে ভর্তি নেয়নি আমার ছেলেকে। আমার ছেলের জীবনটা ধ্বংস করলাম শুধু এই অন্ধকার কারাগারে থাকার কারণে। সব মনে আছে। তাই স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। ক্ষমতায় আসব। তখন দেখা যাবে। এরশাদ বলেন, দুর্বলের সঙ্গে কেউ হাত মেলায় না। তাই আমাদের শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। এখন জাতীয় পার্টি ছাড়া মাঠে কোন রাজনীতি নেই। জাতীয় পার্টি আগামীতে ক্ষমতায় যাবে। তোমরা প্রস্তুত হও, দলকে সময় দাও। দলে নতুন করে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। আমরা ক্ষমতায় আসবই। সভায় তৃণমূল নেতারা আত্মসমালোচনা করে বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থে আমাদের দলের নেতারা অন্য দলের কথা বলেন, কিন্তু এরশাদের কথা কেউ বলেন না। কারও বক্তব্য ছিল, কোন কোন নেতার কারণে দলের ইমেজ ক্ষুন্ন হয়। তাদের ব্যাপারে সচেতন হবার পরামর্শ দেন অনেকে। সাংগঠনিক কর্মকা-ে কেন্দ্রীয় নেতাদের অসহযোগিতার কথা উল্লেখ করে অনেকেই বলেন, ১ জানুয়ারির মহাসমাবেশে পার্টির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক স্পষ্ট কোন ঘোষণা না এলে দলকে আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। যৌথসভায় জাপা কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি দেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী জনগণকে রাজনীতি উপহার দেবে। যারা বলে এরশাদের জাপা দুর্বল তারা জাতীয় পার্টির ভাল চান। বাংলাদেশে এ দলটিই সবচেয়ে স্বচ্ছ একটি রাজনৈতিক দল এবং দলটি নিয়মিত কর্মসূচী নিয়ে সব সময় মাঠে থাকে। আগামীতেও আমরা কোন ষড়যন্ত্র করে নয়, মাঠে থেকে জনগণের ভালবাসা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাব। সভায় বক্তব্য রাখেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, এসএম ফয়সল চিশতি, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ফখরুল ইমাম, মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, মুজিবর রহমান সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান শওকত চৌধুরী এমপি, নুরুল ইসলাম মিলন এমপি, আব্দুস সাত্তার, ইয়াহিয়া চৌধুরী এমপি, নুরুল ইসলাম ওমর এমপি ও এমআর মাসুদ । উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খাঁন, এমএ সাত্তার, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, এসএম মান্নান, মুজিবুল হক চুন্নু, গোলাম কিবরিয়া টিপু, সাইদুর রহমান টেপা, সুনীল শুভ রায়, মীর আব্দুস সবুর আসুদ ও হাজী সাইফুদ্দিন মিলন।
×