ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খেলাপী ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোর তদারকি অব্যাহত

ছোট ব্যবসায়ীরাই ঋণের টাকা পরিশোধে এগিয়ে

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

ছোট ব্যবসায়ীরাই ঋণের টাকা পরিশোধে এগিয়ে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিগত কয়েক বছর ধরে ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলসহ নানামুখী সুবিধা পেয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সুবিধা নেয়া ব্যবসায়ীরা ঋণের টাকা সময়মতো ফেরত দিচ্ছেন না। অথচ যেসব ছোট ব্যবসায়ী পুনর্গঠন ও ঋণ পুনঃতফসিল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তারাই ঋণের টাকা পরিশোধে এগিয়ে রয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় এমন তথ্য জানা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পুনঃতফসিল করা বড় অঙ্কের ঋণের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকা আদায় করতে পারেনি ব্যাংক। কিন্তু ছোট অঙ্কের ঋণের আদায় সন্তোষজনক। তবুও ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও ছোট গ্রাহকের চেয়ে বড় গ্রাহকের দিকে ঝুঁকছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রান্তিকেই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। তিন মাস আগে অর্থাৎ জুন শেষে ছিল ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। ৬ মাস আগে অর্থাৎ মার্চের শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা এবং গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পুনঃতফসিল করা ঋণের টাকা ফেরত না দেয়ায় ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ছোট উদ্যোক্তাদের বঞ্চিত করে বড় উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণেই প্রতি মাসে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বেশি, যদিও বড় ব্যবসায়ীরাও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন। ব্যাংকও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে স্বস্তি পায়। কিন্তু প্রভাবশালীরা টাকা ফেরত না দেয়ার জন্য টালবাহানা করে। এ কারণে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়ে।’ বিআইবিএমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা (৫০ কোটি টাকার বেশি) ঋণের মধ্যে বড় ঋণ ছিল ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয় ২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ২০১২ সালে হয় ২২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে বড় ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৩১ দশমিক ৫৯ শতাংশ হয়। বিআইবিএম পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেভাবে বড় বা বৃহৎ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, একই ভাবে বড় ঋণ ফেরত না দেয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। বিআইবিএমের তথ্য অনুযায়ী, বড় বা বৃহৎ ঋণের মধ্যে ২০১০ সালে খেলাপী ঋণ ছিল সাড়ে ৪ শতাংশ, ২০১২ সালে বৃহৎ ঋণের খেলাপী বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। মোট খেলাপী ঋণের মধ্যে ২০১০ সালে বড় খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০১১ সালে হয় ৩৮ দশমিক ১১ শতাংশ ও ২০১২ সালে ৪০ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১৩ সালে বৃহৎ খেলাপী আরও বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৪২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ও ২০১৪ সালে সেটি ৪৩ দশমিক ৮২ শতাংশ হয়েছে। শুধু খেলাপীই নয়, পুনঃতফসিল করা ঋণের আদায় পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। ২০১৪ সালে প্রথম দফা ঋণ পুনঃতফসিল করা ১২ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকার মধ্যে আদায় ছিল ২৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর মধ্যে বৃহৎ ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। দ্বিতীয় দফা পুনঃতফসিল হওয়া মোট ঋণের মাত্র ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ আদায় হয় ২০১৪ সালে। এর মধ্যে বড় ঋণের গড় আদায় ছিল মাত্র ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর তৃতীয় দফা বা এর বেশিবার পুনঃতফসিল হওয়া ঋণের ৩২ দশমিক ২৫ শতাংশ আদায় হয় ২০১৪ সালে। এর মধ্যে বড় ঋণ আদায় হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনায় ৫শ’ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুবিধায় দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিল হলেও বঞ্চিত হন ছোট ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের প্রতিযোগিতায় নামে। এ সময় প্রায় সাত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে খেলাপীর তকমা থেকে রেহাই দেয়া হয়। এ সুবিধার আওতায় ব্যাংক খাতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল হয়। শুধু তাই নয়, ২০১৫ সালে কয়েক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে বিশেষ সুবিধায় নামমাত্র ডাউন পেমেন্টে খেলাপী ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের ১১টি বড় শিল্প গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন (নিয়মিত) সুবিধা নেয়। এছাড়া ওই সময় আরও প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে দেশের ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে ২৩টি ব্যাংক শীর্ষ ঋণ গ্রহীতাদের পুনর্গঠন সুবিধা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ‘ওই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়েছিল ব্যাংক খাত ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই।’ তিনি বলেন, ‘ওই সময় খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণের সেটা একটা কৌশলের অংশ ছিল। এখনও ব্যাংক খাতের খেলাপী ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোর তদারকি অব্যাহত রয়েছে।’
×