ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:২১, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

চতুর্থ অধ্যায় মহামান্য ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব উদ্্যাপন (গতকালের পর) রমনা পার্কটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছিল। গাছে গাছে ফানুস ও রঙিন কাগজের মালা এবং রং-বেরঙের ছোট ছোট বাতি ঢাকায় ছিল একেবারেই নতুন। তেজগাঁও বিমান পোত থেকে হেয়ার রোড এবং তারপর আবার বিমান পোত রাস্তা দিয়ে কার্জন হল হয়ে সচিবালয় পেরিয়ে গুলিস্তান হয়ে বর্তমান বঙ্গভবনে যাওয়ার পুরো রাস্তাই তখন বর্ধিত করে রাস্তার মাঝখানে বিভাজন স্থাপন করা হয়। শুধু বর্ধমান হাউসের মোড় থেকে সচিবালয় পর্যন্ত রাস্তাটি বিভাজিত হলো না, হলো তিনতলা। (রাস্তার ফুটপাথের পরে হলো রিকশার জন্য স্বতন্ত্র রাস্তা এবং মাঝখানে অবিভাজিত স্বল্প পরিসর রাস্তা।) ঢাকায় এই সময়ের আগে বিভাজিত রাস্তা প্রায় ছিল না এবং মধ্যখানের সবুজ দ্বীপের কোন ধারণাই ছিল না। আলোকসজ্জা সর্বত্র ছিল মনোমুগ্ধকর আর এই উদ্যোগের কারিগর ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হাকিম। রানীর দফতর থেকে বলা হলো যে ১৯০৫ সালে ঢাকায় রমনা বাগানের পরিকল্পনা ও স্থাপনের কাজে সংশ্লিষ্ট একজন বাগান পরিচর্যাবিশারদ তখনও জীবিত ছিলেন। (তার নামও মনে নেই)। তাকে রানীর নাগরিক অভ্যর্থনায় হাজির যেন করা হয়। তাকেও খুঁজে বের করে এই সংবর্ধনায় হাজির করা হয়। মহামান্য রানীর জন্য লাট ভবনে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সিংহভাগই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। আমার মনে হয় সচিবালয়ে গিয়াস উদ্দিন আহমেদ এবং শফিউল আজম ছাড়া আর কোন বাঙালী সচিব ছিলেন না। ঢাকায় জনপ্রশাসনের কমিশনার ছিলেন ওয়াহেদ বক্স কাদরি। তিনি ঢাকার নবাব পরিবারে বিয়ে করার সূত্রে বাঙালী হিসেবে নিজেকে দাবি করতেন। তার এক ভাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দখলের ফলে নৈশভোজে যে ক’জন দেড় শ’ মাত্র অতিথি আমন্ত্রিত হলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন উর্দু ভাষাভাষী। বলে রাখা ভাল যে সামরিক বাহিনীতে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে একজনও বাঙালী ছিলেন না। তখন সরকারী অনুষ্ঠানে যেসব বাঙালী আমন্ত্রণ পেতেন তাদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনার বিষয়। মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিএ ছিলেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি ছিলেন কেরানীগঞ্জের জননেতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমানের চাচাত ভাই এবং ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার পিতা। অন্য বাঙালী ছিলেন ঢাকার নবাব হাসান আসকারী এবং তার চাচা নবাবজাদা আহসানুল্লাহ। তারা কিন্তু উর্দু ভাষাভাষী ছিলেন। চতুর্থ ও পঞ্চম গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী চা-কর মুসলিম রাজনৈতিক নেতা ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘনিষ্ঠ সহচর মির্জা আহমদ হাসান ইস্পাহানি ও তার ছেলে মির্জা সদরি ইস্পাহানি। তাদের পূর্বপুরুষ ইরান থেকে ব্যবসা সূত্রে কলকাতায় হিজরত করেন এবং জননেতা পাকিস্তানের এককালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পিতা বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দীর পরিবারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মির্জা আহমদ হাসান ইস্পাহানি ঢাকায় হিজরত করে বেইলি রোড এলাকায় তার বাড়ি নির্মাণ করেন এবং সেখানে ইস্পাহানি কলোনি নামে খ্যাত আবাসস্থলে অনেক ঘরবাড়ি স্থাপন করেন। এসব ঘরবাড়িতে মূলত সরকারী বা আধা-সরকারী কর্মচারীদের বেশ কম ভাড়ায় থাকতে দেয়া হতো। এই কলোনির পরিচালনা তার জীবিত অবস্থায়ই তিনি তার নাতি জোবায়ের ইস্পাহানিকে প্রদান করেন। মির্জা সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি ১৯৮১ সালে সরকারী চাকরি ছাড়লে তিনি আমাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মূল্যবান উপদেশ দান করেন। নৈশভোজে যখন রাজকীয় দলবলকে নিয়ে আমি পৌঁছলাম তখন হঠাৎ দেখি আমার বোন বর্তমানে প্রসিদ্ধ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ড. শাহলা খাতুন তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে তাতে হাজির হয়েছেন। আমার মাধ্যমেই নৈশভোজে অংশগ্রহণকারীদের চিঠিপত্র বিলি হয় এবং তার নামে কোন দাওয়াতপত্র ছিল না। তাই সেখানে আমার বোনের উপস্থিতিটা আমাকে বিস্মিত করল। যাইহোক, সেই বিস্ময়ের সমাধান কিছুক্ষণ পরেই পেলাম। যখন দেখলাম যে, আরও কিছু ছাত্রছাত্রী যাদের অনেককে আমি চিনি তারাও এই আসরে হাজির হয়েছে। লাট সাহেব জেনারেল আজম ডিউকের প্রশ্নটি ঝড়হ ড়ভ ঃযব ঝড়রষ শুধু শোনেননি বরং তার অন্তনির্হিত উদ্দেশ্যও ভাল করে বুঝেছিলেন। তাই তিনি লাট ভবনে ফিরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যেসব প্রতিনিধি নিমন্ত্রিত ছিলেন যেমন উপাচার্য, শীর্ষ অধ্যাপকবৃন্দ, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোর প্রভোস্ট, তাদের সবাইকে পাঁচজন করে ছাত্রছাত্রী নিয়ে নৈশভোজে হাজির হওয়ার হুকুম দেন। বস্তুতই লাট সাহেব একটি লজ্জা নিরসনের উত্তম প্রয়াস গ্রহণ করেন। ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান অথচ সেখানে বাঙালীর উপস্থিতি অতি নির্দিষ্ট হওয়াটা খুবই বেমানান ছিল। মহামান্য রানীর জন্য একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সমৃদ্ধ বাঙালী নাচগানেরই ব্যবস্থা ছিল। আমার মনে হয় নৈশভোজের প্রাক্কালেই এই অনুষ্ঠানটি লাট ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। তখন লাট ভবনে এখন যেটি বঙ্গভবন সেইটি মাত্র নির্মিত হচ্ছিল। একমাত্র মানুক হাউসই ছিল যথোপযুক্ত স্থাপনা। চলবে...
×