ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রদীপ মালাকার

রামু থেকে নাসিরনগর

প্রকাশিত: ০৩:২০, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

রামু থেকে নাসিরনগর

আবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলায় রসরাজ দাস নামে এক ব্যক্তির ফেসবুকে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাত তুলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ’৭১-এর হায়ানার মতো হিন্দু পল্লীতে তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা হিন্দুদের তিন শতাধিক বাড়ি ও পাঁচটি মন্দিরে হামলা, ভাংচুর এবং লুটতরাজের পাশাপাশি মহিলাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। পুরোহিতসহ আহত হয় শতাধিক নারী-পুরুষ। অনুরূপভাবে ২০১২ সালে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধ পল্লীতে তিন শতাধিক বাড়িঘর, প্যাগোডাসহ পাঁচ শ’ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং লুটতরাজ, ভাংচুরসহ নারী নির্যাতন চালায়। এখানেও উত্তম বড়ুয়া নামে অল্প শিক্ষিত এক যুবকের ফেসবুকের এক ছবিকে কেন্দ্র করে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে জামায়াতসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রোহিঙ্গা জঙ্গীদের সহায়তায় রামুর বৌদ্ধ পল্লী, আনোয়ারাসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালিয়েছিল। রামুর ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছিল, কথিত উত্তম বড়ুয়ার সঙ্গে স্থানীয় শিবির ক্যাডারের সখ্যের সুযোগ নিয়ে উত্তমের ফেসবুক আইডি চুরি করে তার মাধ্যমেই কারসাজির ঘটনাটি ঘটেছিল। পুলিশ পরে তাকে গ্রেফতারও করে। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের নন্দিরহাটের ঘটনায় জামায়াতীরা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৫০ টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে রাতের আঁধারে মসজিদের দেয়াল ভেঙ্গে হিন্দুদের ওপর দোষ চাপিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা করেছে। ২০১২ সালের ৪ আগস্ট দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় দেড় শ’ বছরের পুরনো কালীমন্দির থেকে ৫০০ গজ দূরে মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাবকে বিকৃতি করে জামায়াত নেতা তোয়াব হাজীর নেতৃত্বে ও উপজেলা চেয়ারম্যান আফতাবউদ্দিন মোল্লার উস্কানিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের উছিলা দিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে বাড়িঘরে লুটপাট, আগুন ও মন্দির ধ্বংস করে। একই বছরে সাতক্ষীরার ফতেহপুর গ্রামে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আবুল মনসুর রচিত ‘হুজুর কেবলা’ নাটকটিতে নাকি নবীজি সমন্ধে কটাক্ষ করা হয়েছে – এই মর্মে স্থানীয় পত্রিকায় এক জামায়াত সাংবাদিক প্রতিবেদন ছাপে। উক্ত মিথ্যা প্রতিবেদনকে আশ্রয় করে জামায়াত নেতারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের উছিলা তুলে ফতেহপুর গ্রাম এবং দুদিন পর পার্শ্ববর্তী চাকদহ গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য বাড়িঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তদন্তে প্রতিবেদনটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যশোরের মালোপাড়ায় বিকেলের দিকে ৪ জন মুসলমানকে মালোপাড়ায় হত্যা করা হয়েছে– এমন গুজব রটিয়ে উক্ত গ্রামের ১২৫টি হিন্দু বসতবাড়ি, মন্দিরে আগুন, লুটপাট ও মহিলাদের শ্লীলতাহানি ঘটানো হয়েছে। এ রকম আরও অনেক ঘটনা গত দেড় দশকে ঘটেছে, যার সব ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। একদিকে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে দেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে এবং হিন্দুদের কাছে আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয়হীন করে ভোট ব্যাংকে ধস নামানো। অন্যদিকে ভারতসহ বন্ধু দেশের সমর্থন প্রত্যাহার এবং সরকারকে বেসামাল অবস্থায় নিয়ে যেতে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতেই জামায়াতসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ রকম ফন্দি এঁটেছিল বলে রাজনৈতিক পণ্ডিতদের ধারণা। সব ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হামলার আগে ভিকটিমরা খবর দিলে কিংবা সাহায্যের জন্য কাকুতি মিনতি করেও ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আন্তরিক থাকলেও সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক দুষ্টচক্র, অদক্ষ, অদূরদর্শী কিছু মন্ত্রী, সাংসদ, আমলা ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যথাসময়ে নিরাপওা পায় না। ২০১৫ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে, হিন্দুদের সম্পত্তি দখল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়নি। রাজনৈতিক পরিচয় ও আদর্শ থেকে বের হয়ে এসে তারা সম্পত্তি দখল ও নির্যাতনে অংশ নিয়েছে। যেমন, গত ১৩ মার্চ বরগুনার তালতলি উপজেলার চন্দনতলা গ্রামে স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা একযোগে ১৪টি হিন্দু পরিবারে হামলা করে তাদের ৪০ একর জমি দখলের চেষ্টা করে। নাসিরনগরেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বে কোন্দল ও ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকায় মৌলবাদীদের উস্কে দেয়া হয়। তার ওপর আছে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপের রাজনীতি। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জামায়াত-বিএনপির চেয়েও অতি উৎসাহী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আর বিরোধী পক্ষ সেই সুযোগ লুফে নিয়ে হিন্দু নির্যাতনের তকমাটা তাদের গায়েও লাগিয়ে দিয়েছে। সেই পুরনো বানর-ছাগলের গল্পের মতো- বানর হাঁড়ির সব মাখন খেয়ে সামান্য কিছু মাখন ছাগলের দাঁড়িতে লাগিয়ে দিয়ে বাড়ির মালিকের প্রশ্নের জবাবে বলে, আমি খাইনি ছাগল খেয়েছে। রামুর ঘটনায় আমরা দেখেছি, বিএনপি-জামায়াত ও ধর্মান্ধ দলগুলোর প্রতিবাদ, সমাবেশ মিছিলের পাশাপাশি যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মৎস্যজীবী লীগও মিছিল সমাবেশ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা চেয়ারম্যানের সমাবেশে বক্তব্য শেষ হওয়ার ঘণ্টা খানিক পরই জামায়াত-বিএনপি ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রোহিঙ্গা জঙ্গীদের সহায়তায় রামুর পল্লীতে হামলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনায় জামায়াত সমর্থিত আহলে সুন্নত জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম প্রথমে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। পাশাপাশি একই দিনে আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের তিন নেতার নেতৃত্বেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিল হয়। তার পরের দিন মাদ্রাসা ছাত্রদের বিরাট বিক্ষোভ মিছিল দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নাসিরনগর সদরের দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, নমশূদ্রপাড়ায় হামলাসহ প্রত্যন্ত হরিণবেড় গ্রামের তিন শ’ বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। যখন এই লেখাটি শেষ করি তখন চ্যানেল আইয়ের সংবাদে গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে বলা হয়, বাইরে থেকে ছবি ডাউনলোড করে এবং রসরাজ দাশের আইডি চুরি করে তার মোবাইলে পাঠানো হয়। রসরাজ নিজেও এই বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করে বার বার উপস্থিত মাতব্বরদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তার পরও মাতবররা রসরাজকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পর পুলিশ এসে রসরাজকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। রসরাজ তো কোন নামী-দামী, সংগঠনের নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন না। রসরাজ ছিলেন গ্রামের মধ্যেই অপরিচিত তৃতীয় শ্রেণী পাস খেটে খাওয়া অতি দরিদ্র জেলে পরিবারের সদস্য। তার বিরুদ্ধে বড় মিছিল, সমাবেশ কিসের লক্ষণ ছিল? অতীতের এ ধরনের ঘটনা থেকে তা আওয়ামী নেতারা বা প্রশাসন কি জানত না? রসরাজকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তার পরেই হামলা, তাণ্ডবের ঘটনা ঘটল। তার দুই দিন পর স্থানীয় মসজিদের ভেতরে হিন্দুদের লক্ষ্মী প্রতিমা কে বা কারা রেখে যায়। নাকি এটিও রসরাজ পুলিশ হেফাজতে থেকে মসজিদে প্রতিমা রেখে যায়! এই নাসিরনগরের ঘটনাকে ইস্যু করে দুই দিন পর নওগাঁ, দিনাজপুর, গোবিন্দগঞ্জ ও নেত্রকোনায় হিন্দুদের বাড়ি ঘরে হামলা, মন্দির দখল ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। আর রামুসহ এসব হামলায় বিরোধী দল বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ ঘটিয়েছে। আর আওয়ামী লীগ দোষ চাপাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত ঘটিয়েছে। যারাই ঘটাক, ভিকটিমসহ দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ ধারাবাহিক দৃশ্যমান ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়েই বুঝতে পারে কারা ঘটিয়েছে? কিন্তু ব্লেইম গেমের এই আত্মঘাতী রাজনীতির কারণে একবার যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে কারা লাভবান হবে তা উভয় বড় দলকেই অনুধাবন করতে হবে। সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান এবং নির্যাতনের ঘটনাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই দেশের মানুষ মনে করে, সরকার দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারের ব্যবস্থা করে নির্যাতিতদের মনে আস্থা ও সাহস যোগাবেন। সামনে নির্বাচন ও অন্যান্য ইস্যুতে আবারও সংখ্যালঘুরা টার্গেট হতে পারে। কাজেই সরকার আগের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, অধিকারসহ তাদের নিয়ে কুটিল ভোট ব্যাংক রাজনীতি ও কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাজনীতি বন্ধে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। পাশাপাশি সংসদে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একটি হেইট ক্রাইম অথবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিল এনে এবং তা বাস্তবায়নে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা সময়ের দাবি, জাতীয় দাবি। তা না হলে সরকারের সব অর্জন ও স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×