ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এয়ারটেলের ১২ হাজার কোটি যোগ হয়ে বিনিয়োগ ২৮ হাজার কোটি টাকা

একীভূত রবিই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

একীভূত রবিই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর

আরাফাত মুন্না ॥ দেশে প্রথমবারের মতো একীভূত হয়েছে দুটি মোবাইল অপারেটর রবি ও এয়ারটেল। গত ১৬ নবেম্বর থেকে একীভূত কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে তারা। রবি-এয়ারটেলের একীভূত হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে টেলিযোগাযোগ খাতে সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর আগে দেশে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অধিগ্রহণ (এ্যাকুইজিশন) হয়েছে। আরেক কোম্পানির কিনে নেয়ার ঘটনাও রয়েছে। তবে আর্থিক ও গ্রাহকসংখ্যার দিক থেকে বড় দুই কোম্পানি একীভূত হওয়ার ঘটনা খুব বেশি নেই। রবি সূত্রে জানা গেছে, একীভূত হওয়ার ফলে রবি ও এয়ারটেল- দুই কোম্পানির গ্রাহকরাই পরিচিত হবেন ‘রবি’ গ্রাহক হিসেবে। আর এর ফলে রবি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর হিসেবে স্থান পেয়েছে। রবির ‘০১৮’ ও এয়ারটেলের ‘০১৬’ কোডযুক্ত সব নম্বরই আগের মতো থাকবে। দুই কোডের গ্রাহকই পাবেন রবির সব সুযোগ-সুবিধা। নতুন গঠিত কোম্পানিতে রবির অংশ থাকবে ৭৫ শতাংশ আর এয়ারটেলের থাকবে ২৫ শতাংশ মালিকানা। বর্তমানে রবির ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ আর ৮ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক জাপানের এনটিটি ডোকোমো। এয়ারটেল বাংলাদেশের ১০০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ভারতীয় এয়ারটেল। বাংলাদেশে এর আগে ২০০৪ সালে সেবা টেলিকম কিনে নিয়ে বাংলালিংক নামে ব্যবসা শুরু করে মিসরের ওরাসকম টেলিকম। একইভাবে ২০১০ সালে ওয়ারিদ টেলিকমকে অধিগ্রহণের মাধ্যমেই বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে এয়ারটেল। টেলিযোগাযোগ খাতের বাইরে ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাতেও বাংলাদেশে এমন বেশ কিছু অধিগ্রহণের উদাহরণ আছে। জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একীভূত ও অধিগ্রহণের (মার্জার এ্যান্ড এ্যাকুইজিশন) মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানির এক হওয়ার এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের দুই মোবাইল অপারেটর টি-মোবাইল ও অরেঞ্জ একীভূত হয়ে এভরিথিং এভরিহোয়্যার (ইই) নামে ব্যবসা করছে। তবে এখন পর্যন্ত অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণের ঘটনা হয়েছে ১৯৯৯ সালে। জার্মানির মোবাইল অপারেটর মানেসমানকে অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ভোডাফোন, ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে। তবে রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অর্থের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি। একীভূত হওয়ার পূর্বে রবির বার্ষিক আয় ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর এয়ারটেলের বার্ষিক আয় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছিল। যৌথ কোম্পানি হিসেবে অপারেটর দুটির বার্ষিক আয় দাঁড়াবে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৫ কোটি ৫৫ লাখ গ্রাহক নিয়ে মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে শীর্ষে আছে গ্রামীণফোন। ৩ কোটি ২৬ লাখ গ্রাহক নিয়ে বাংলালিংক দ্বিতীয়, একীভূত হওয়ার পূর্বে ২ কোটি ৮৩ লাখ গ্রাহক নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল রবি। এবং এয়ারটেলের গ্রাহক ছিল ১ কোটি। রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের গ্রাহকসংখ্যা রয়েছে ৪১ লাখ ৮ হাজার। বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বাস্তবতায় টেলিকম খাতে কোন কোম্পানির বাজার অংশীদারিত্ব নির্ধারিত একটি অংশ নিশ্চিত করা গেলে ওই কোম্পানি না লাভ, না লোকসান অবস্থায় পৌঁছায়। এর ওপরে যার যত বাজার অংশীদারিত্ব থাকে, সেই অনুপাতে সে লাভের দেখা পায়। তাই রবি ও এয়ারটেল একীভূত হওয়ার ফলে তাদের লাভের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। এ ছাড়া একীভূত হওয়ার ফলে মানবসম্পদের ব্যবহার ভাল হবে। বিভিন্ন ধরনের সম্পদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আর্থিক সাশ্রয় ঘটবে। মোবাইল ও টেলিযোগাযোগ সেবায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তরঙ্গ। একীভূত রবি-এয়ারটেলের মোট তরঙ্গের পরিমাণ সব মোবাইল অপারেটরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে এয়ারটেলের কাছে ২০ মেগাহার্টজ আর রবির কাছে আছে ১৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। দুটি প্রতিষ্ঠানের মোট তরঙ্গের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ। আর গ্রামীণফোনের কাছে সর্বোচ্চ ৩২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ আছে। উন্নত মানের ভয়েস কল, দ্রুতগতির ইন্টারনেট থেকে শুরু করে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল সেবা দেয়ার জন্য তরঙ্গ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এদিকে, রবি ও এয়ারটেল একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর সময় প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবিষ্যত কি হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা উঠেছিল। তবে কেটে গেছে সব শঙ্কাই। এয়ারটেলের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীই যোগ দিয়েছেন রবিতে। রবি কাউকেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেনি বলে রবি সূত্র জানায়। গত মঙ্গলবার রাজধানীতে এক বর্ণাট্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এয়ারটেল থেকে যোগ দেয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরণ করে নেয় রবি। ওই অনুষ্ঠানে রবির ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ্যান্ড সিইও মাহতাব উদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, এয়ারটেলের বেশিরভাগ কর্মী একীভূত কোম্পানি রবিতে যোগ দেয়ায় আমরা গর্বিত। আমি নিশ্চিত, আপনাদের কঠোর পরিশ্রম ও একাগ্রতায় আমরা শীঘ্রই মার্কেট লিডারে পরিণত হতে পারব। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে একীভূত হয়ে ব্যবসা পরিচালনার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেয় রবি ও এয়ারটেল। এর পর কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ অনুযায়ী একীভূত হতে উচ্চ আদালতের অনুমোদনও নেয় কোম্পানি দুটি। এর পর বিটিআরসির চূড়ান্ত অনুমোদনের পর গত ১৬ নবেম্বর থেকে একীভূত কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে কোম্পানি দুটি। একীভূত হওয়ার পর থেকে রবি নামেই পরিচিতি পাবে তারা। একীভূত হওয়ার পর সারা দেশে রবি ও এয়ারটেলের ১০০-এর বেশি নিজস্ব গ্রাহকসেবা কেন্দ্র, ১১ হাজার পরিবেশক ও আড়াই লাখ খুচরা বিক্রেতা এক ছাতার নিচে চলে আসে। রবি ও এয়ারটেলের মোবাইল টাওয়ার আছে ১৪ হাজারের বেশি, এর মধ্যে রবির টাওয়ার সংখ্যা ৮ হাজার ৭০০ ও এয়ারটেলের সাড়ে ৫ হাজার। রবির বাংলাদেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। টেলিকম মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের শিল্পগোষ্ঠী এ কে খান গ্রুপের যৌথ অংশীদারির এই কোম্পানি ২০১০ পর্যন্ত একটেল নামে পরিচালিত হয়। পরে ২০১০ সালে একটেল কিনে নেয় আজিয়াটা গ্রুপ। আর নাম হয় রবি। যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত রবি বাংলাদেশে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আর ওয়ারিদ টেলিকমকে ২০১০ সালে কিনে নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে এয়ারটেল। এখন পর্যন্ত এ দেশে এয়ারটেল বিনিয়োগ করেছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি হিসাবে আজিয়াটা গ্রুপ ১০ দেশে ৩০০ মিলিয়ন গ্রাহককে টেলিযোগাযোগ সেবা দিচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোতে বেশিরভাগ মালিকানা রয়েছে আজিয়াটার। মালয়েশিয়ায় ‘সেলকম’, ইন্দোনেশিয়ায় ‘এক্সএল’, শ্রীলঙ্কায় ‘ডায়ালগ’, বাংলাদেশে ‘রবি’, কম্বোডিয়ায় ‘স্মার্ট’, নেপালে ‘এনসেল’ এবং কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভারতে ‘আইডিয়া’ ও সিঙ্গাপুরে ‘এম ওয়ান’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে আজিয়াটা।
×