ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় কলকাতার মাদল

বাংলার মায়েদের মেয়েদের গান করি, বাংলাদেশ অনুপ্রেরণা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

বাংলার মায়েদের মেয়েদের  গান করি, বাংলাদেশ  অনুপ্রেরণা

মোরসালিন মিজান ॥ পরিবর্তনের যে হাওয়া, জোরেশোরেই বইছে কলকাতায়। অনেক কিছু এরই মাঝে ভেসে গেছে। বদলে যাচ্ছে চোখের সামনে। অন্যের আচার সংস্কৃতি নিয়ে হুড়োহুড়িটা লক্ষ্য করার মতো। তবে মাদল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। লোক গানের এই দলটি বাংলা ও বাঙালীর নিজের যা, তা নিয়ে আছে। তা-ই নিয়ে আছে। সুধামাটির গন্ধ মাখা গান করেন শিল্পীরা। এবং যারা গান করেন তাদের সকলেই নারী। মাদল কলকাতার নারীদের প্রথম লোকগানের দল। বিভিন্ন বয়সী নারীরা এই প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়েছেন। বাংলার মেয়েদের মায়েদের উৎসব পার্বণের গানগুলো গাইছেন তারা। লোককবিদের দর্শন প্রচার করছেন। ওপার বাংলায় জনপ্রিয়। টেলিভিশনে খুব দেখা যায়। আর এপারে তো কারও কারও নাড়ি পোঁতা! ঢাকায় আমন্ত্রিত হয়ে আসা শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল আরও অনেক খুঁটিনাটি। মাদলের ছয় গায়িকা। শিখা ভট্টাচার্য, শম্পা, শর্মিষ্ঠা, সোনিয়া, টুকশী ও পলাশপ্রিয়া। শিখা ভট্টাচার্য, শম্পা ও শর্মিষ্ঠা এসেছেন ঢাকায়। তিন শিল্পীর গান শোনা হয়েছিল আগেই। কথা হলো রবিবার। তাদের হোটেল কক্ষে। মুখপাত্রের ভূমিকায় ছিলেন শিখা ভট্টাচার্য। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকসঙ্গীতে মাস্টার্স করেছেন তিনি। এই ধারার গানের প্রতি ভীষণ প্রেম। ভালবেসে গাইতেন। আর তার পর ২০০২ সালে মাদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। শিখা বলেন, ছেলেদের তো দলের কোন অভাব নেই। ওদের গান শুনতাম। টিভিতে দেখতাম। দেখে দেখেই একদিন মনে হলো, মেয়েদের দল কেন নয়? সমমনা কয়েকজনকে পাওয়া গেল। সবাই মিলে কাজ শুরু করে দিলাম। মাদলের ব্যাখ্যা দিয়ে শিখা বলেন, আমরা লোক গান করব। দলের নামকরণের ক্ষেত্রে এটি মাথায় ছিল। তাই লোকবাদ্য যন্ত্রের নামে নামÑ মাদল। পাশে বসেছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের আরেক সদস্য শর্মিষ্ঠা। আলোচনায় যোগ দিয়ে তিনি বলেন, মায়েদের দল। মেয়েদের দল। এ অর্থেও মাদল। মঞ্চে আমরা দল বেধে ওঠি। দল বেধে নামি। শম্পা বলেন, নকল সময়ের চাহিদা হিসাব করে গাইলে রাতারাতি কিছু করে ফেলা যেত। আমরা প্রলোভন উপেক্ষা করে দীর্ঘ পথ হেঁটেছি। কমিটমেন্টের একটা জায়গা ছিল। লক্ষ্য ছিল। আমরা লোকসঙ্গীতের সঙ্গে কিছু যোগ বিয়োগ করি না। ফিউশনের নামে যা মন চায় করতে বাধে। বাকিটা জানিয়ে শিখা বলেন, আমরা মূল গান সংগ্রহ করি। কথা সুর নিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়। তার পর গাই। মাদলের শিল্পীদের উপস্থাপনার ঢংটিও আলাদা। শিখা বলেন, লোকগান গাওয়া মানেই মাথায় গামছা বেঁধে নামা। একতারা বাজাতে না পারলেও, হাতে নিয়ে মঞ্চে ওঠা। আমরা এ ধরনের আরোপিত কিছু করি না। সবাই একই রঙের পোশাক পরে মঞ্চে ওঠি। এটা বলতে পারেন, আমাদের নিজস্বতা। বর্তমানে কলকাতায় মাদল মানে বাঙালীর আবেগ আর আদরমাখা গানগুলো। এখানে ওখানে অনুষ্ঠান। টেলিভিশনে শো। চলতেই থাকে। হিন্দি ইংলিশের কলকাতায় দিব্যি আছে মাদল। শিখা বলেন, শহুরে শ্রোতার সামনে বিভিন্ন ধারার লোকসঙ্গীত করি আমরা। বার বার গাওয়া আসর জমানো গান পারতপক্ষে গাই না। লালন শাহ, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ, দূরবীন শাহ, পাঞ্চুশাহর মতো সাধকদের গান গাওয়ার চেষ্টা করি। লোককবিদের দর্শন তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরি। তারাও আগ্রহভরে শুনছে। বোঝার চেষ্টা করছে। লোকসঙ্গীতের চর্চার বিশাল অধ্যায়জুড়ে আছে নারীদের অংশগ্রহণ। সে প্রসঙ্গ তুলে শিখা ভট্টাটার্য বলেন, আমরা উৎসব পার্বণে বউ ঝিদের গাওয়া গানগুলো এখন গাই। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে যে ধামাইল গান হতো, আমরা সেগুলো করি। ভাদু গান করি। টুসু গান করি। ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি সারি চটকা বিচ্ছেদী গান শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেই। অবশ্য মাদলেরও আছে একটি বিচ্ছেদের ঘটনা। ২০১৪ সালে একজন গায়িকা দল ছেড়ে যান। যোগ হন আরও দুই জন। যোগ হওয়ার চেয়ে বিচ্ছেদ বেশি আলোচিত। কারণ, দল ছেড়ে যাওয়া ওই সদস্য কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আরকেকটি দল গঠন করেছেন। সেটিরও নাম রেখেছেন মাদল। তাই? জানতে চাইলে বিব্রতবোধ করেন মাদলের তিন শিল্পী। শিখা ভট্টাচার্য বলেন, কী যে মুশকিলে পরেছি। বিরুদ্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে গান করি। স্বামী সংসার আছে। তার ওপর নতুন নতুন সমস্যা। তবে শুধু নাম নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না। আমরা কাজ নিয়ে আছি। থাকতে চাই। আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসছিল বার বারই। শর্মিষ্ঠা বলেন, বাংলাদেশ তো লোকগানের উর্বর ভূমি। আমরা মায়েদের মেয়েদের গান করি। এ ক্ষেত্রে বড় অনুপ্রেরণা বাংলাদেশ। এ অঞ্চলের গানই বেশি করি আমরা। এবার ঢাকায় গেয়ে কেমন সারা পেলেন? জানতে চাইলে শম্পা বলেন, দারুণ! টেলিভিশন ও ইউটিউবের কল্যানে অনেক শ্রোতা হয়েছে, জানা ছিল না। তাদের সঙ্গে কথা বলে বেশ একটা অনুভূতি হয়েছে। কতজন কতভাবে যে তাদের ভাললাগার কথা জানাল! শেষ করেন শিখা ভট্টাচার্য। বলেন, এই দেশে দ্বিতীয়বারের মতো এসেছি। এবার শ্রোতাদের ভালবাসা আরও বেশি টের পেলাম। এই ভালবাসার টানেই বার বার বাংলাদেশে আসতে চাই। এটা তো বাংলার দেশ। মাদলের দসস্যরা আজ সোমবার বিকেলে ঢাকা ছেড়ে যাবেন।
×