ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পুলিশ ইচ্ছা করলে সবই পারে!

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

পুলিশ ইচ্ছা করলে সবই পারে!

শংকর কুমার দে ॥ পুলিশ ইচ্ছা করলে সবই করতে পারে। কোন কোন ঘটনার তদন্তের সাফল্যের প্রশংসায় দেশ-বিদেশে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলছে। আবার কোন কোন ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ কি ইচ্ছা করেই করে না? পুলিশের সাহস, দক্ষতা, মেধা, নিষ্ঠাকেও এ জাতীয় কাজ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। অসম্ভবকে সম্ভব করার উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি পুলিশ ইচ্ছা করা সত্ত্বেও ব্যর্থতার ছাপের জ্বলন্ত উদাহরণ স্থাপন করছে। পুলিশ ইচ্ছা করলেই যে পারে তা সাম্প্রতিক কয়েকটি আলোচিত ঘটনায় শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলেছে। নেদারল্যান্ডসের ঢাকার রাষ্ট্রদূতের হ্যান্ডব্যাগ চুরি যাওয়ার দুই দিনের মাথায় উদ্ধারের ঘটনাটি এমনই একটি দৃষ্টান্ত। ধর্ষক রুবেল আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার হওয়ার মতো ঘটনাটি পুলিশের ঈর্ষণীয় সাফল্যের চমক সৃষ্টি করেছে। আবার অনেক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে বছরের পর বছর পার করে দিয়ে পুলিশের দক্ষতা, মেধা, নিষ্ঠাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার অন্যান্য নজির স্থাপন করেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী, কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ও চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকা-ের তদন্তে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে পুলিশ কি ইচ্ছা করেই করে না? তাহলে নেদারল্যান্ডস রাষ্ট্রদূতের চুরি যাওয়া ব্যাগ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই উদ্ধার করে দুই চোর আটকসহ চুরির ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন, ধর্ষক রুবেল হাতকড়া পরা অবস্থায় আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দিনের মাথায় আবারও গ্রেফতার হলো কিভাবে? গত ২১ নবেম্বর সোমবার সন্ধ্যা প্রায় ৭টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ‘ফ্রিডম’ নামের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী একটি অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি মার্গারিটা কুয়েলিনারি। রাষ্ট্রদূত তার ব্যাগটি রেখে মঙ্গলবাতি জ্বালাতে যান। বাতি জ্বালিয়ে নিজ চেয়ারে ফিরে গিয়ে ব্যাগটি খুঁজে পাননি তিনি। হইচই পড়ে গেল অনুষ্ঠান স্থলে। দেশের মান-সম্মানের বিষয়। পুলিশ এসে ঘটনার তদন্ত শুরু করল। ক্লোজসার্কিট ক্যামেরাতে (সিসি টিভি) দেখা গেল এক যুবক ভ্যানেটি ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সিসি টিভিতে যুবকটিকে দেখা গেল ব্যাগ নিয়ে ভিড়ের মধ্যে কৌশলে অনুষ্ঠান স্থল ত্যাগ করে। কিন্তু এই যুবকটি কে? কোথায় থাকে? বিদেশী রাষ্ট্রদূতের ভ্যানেটি ব্যাগ উদ্ধার না করলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। ব্যাগে রাষ্ট্রদূতের ট্যাব, মোবাইল ফোন, ব্যাংকের কার্ড, বাসার চাবি ও ব্যক্তিগত জরুরী কাগজপত্র ছিল। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। শুরু হয় মামলার তদন্ত। ডিবির যুগ্মকমিশনার বলেন, চারুকলা থেকে বেরিয়ে রুবেল দ্রুত ব্যাগটি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে যায়। শপিং মলের লেভেল-৫ এর বি-ব্লকের ৪৫ নম্বর দোকানের (আই-টাচ) সোলাইমান ওরফে শাওনের হাতে সে ব্যাগটি দেয়। ব্যাগের ভেতরে থাকা ট্যাব, মোবাইল ও বিদেশী মুদ্রা দেখে শাওন তাকে ১০ হাজার টাকা দেয়। সবকিছু বিক্রি করার পর আরও টাকা দেবে বলে রুবেলকে আশ্বাস দেয় শাওন। তখন রুবেল সবকিছু শাওনের কাছে রেখে বাড়ি চলে আসে। পরদিন রুবেল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার ছবি দেখতে পায়। এতে ভীত হয়ে সে ক্লিন সেভ করে নিজের চেহারা বদলানোর চেষ্টা করে। এদিকে শাহবাগ থানায় মামলা হওয়ার পর চোরকে ধরতে মাঠে নামে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। চেহারায় মিল আছে এমন বেশ কয়েকজনকে আটকও করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার সকালে রাজধানীর শনিরআখড়া থেকে আসল চোর রুবেলকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় গোয়েন্দা (দক্ষিণ) বিভাগের একটি দল। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এ সংক্রান্তে শাহবাগ থানায় মামলা রুজু হলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি অনুসন্ধানে মাঠে নামে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে একই চেহারার বেশ কয়েকজনকে আটক করে। পরে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রুবেলকে শনাক্ত করা হয়। এরপর পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কর্মরত এএসআই সাইফুলই প্রথমে রুবেলের ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করেন। সাইফুল জানান, শনিরআখড়ার শেখদী এলাকায় তার বাড়ির পাশেই থাকে রুবেল। পরে শনিরআখড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে রুবেলকে গ্রেফতার করা হয়। আর তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বসুন্ধরা শপিংমলের লেভেল-৫ এর আই-টাচ দোকান থেকে গ্রেফতার করা হয় শাওনকে। পরে শাওনের কাছ থেকে ডাচ রাষ্ট্রদূতের চুরি যাওয়া ব্যাগ, পাসপোর্ট, ট্যাব ও মোবাইল উদ্ধার করা হয়। রুবেলের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে। সে ঢাকায় রেন্ট-এ-কার চালাত। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সে একটি সংঘবদ্ধ চোরচক্রের সঙ্গে কাজ করে আসছিল। ব্যাগ চুরির দুই দিন পর ব্যাগটি উদ্ধার করার পর পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত লিওনি মার্গারিটা কুয়েলিনারি। রাষ্ট্রদূতের পুলিশকে ধন্যবাদ জানানোর ঘটনাটি তাদের ভাবমূর্তি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও উজ্জ্বল করে তুলেছে। পুলিশ ইচ্ছা করলেই যে সব করতে পারে, তার উদাহরণ আছে আরও অনেক। বাড্ডায় গারো তরুণী ধর্ষণকারী রুবেল আদালতের খাসকামরা থেকে পালানোর পর তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার মতো আরেকটি ঘটনা। ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, গত ১১ নবেম্বর রাতে বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকা থেকে ধর্ষক রুবেলকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১। পরে তাকে বাড্ডা থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলে তাকে রিমান্ডের জন্য আদালতে নেয়া হয়। পরে আদালতের খাসকামরা থেকে পালিয়ে যায় রুবেল। গত ১৩ নবেম্বর আদালত থেকে পালানোর সময় রুবেলের ডান হাতে হাতকড়া ছিল। এ সময় হাতকড়াসহ হাতটি পকেটে করে পালিয়ে যায় রুবেল। এরপর পুরান ঢাকার একটি তুলার দোকানে গিয়ে তার ওই হাতকড়াসহ হাতটি ব্যান্ডেজ করে। পরে তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে এক হাজার টাকা আনে। সেখান থেকে পুরান ঢাকার একটি মসজিদে গিয়ে বসে থাকে রুবেল। সেখানে আসরের নামাজ আদায় করে। মসজিদ থেকে বের হয়ে পাশের দোকান থেকে একটি সিগারেট ও এক কাপ চা খায়। সন্ধ্যার পর সেখান থেকে বাড্ডা এলাকায় যায়। সেখান থেকে পালিয়ে ভাটারার নুরের চালা এলাকায় যায়। সেখানে একটি বাড়ির ছাদে রাত কাটায়। সোমবার সকালে টঙ্গী বোর্ডবাজার এলাকায় যায়। সেখানে হাতকড়া কাটতে না পেরে আবার চলে আসে বাড্ডা এলাকায়। এরপর সুবাস্তু টাওয়ারের পেছনে খালের পাশে গিয়ে দুটি ঘরের চিপায় খালি জায়গাতে রাতে ঘুমায়। সকালে একজন সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে দেখে চিনে ফেলে জড়িয়ে ধরে। এতে রুবেল ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করতে থাকে। চিৎকার শুনে পাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে আসে। তখন ওই পুলিশ সদস্য বলেন, এই যুবক আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া রুবেল। তখন পুলিশ সদস্যরা তার হাতের ব্যান্ডেজ খুলতেই হাতকড়া বেরিয়ে আসে। এরপর তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। রুবেলকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে আরও জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসে। আদালত থেকে হাতকড়া পরা অবস্থায় পালানোর দুই দিন পর ধর্ষক রুবেলকে গ্রেফতার করে আবারও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার ঘটনাটি প্রমাণ করে পুলিশ ইচ্ছা করলে সবই করতে পারে। কিন্তু ইচ্ছা করলেও পুলিশ পারে না কেনÑ সেই প্রশ্নও আছে। তার উদাহরণ হচ্ছেÑ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী, কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ও চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকা-ের তদন্তে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। কেন তদন্তের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নিÑ পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে প্রত্যুত্তরে দিয়েছেন নানা ধরনের বক্তব্য। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা- ॥ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-ের ঘটনাটি ৫ বছর ৮ মাসেও উদ্ঘাটিত হয়নি। চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত এ মামলাটি। ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতের কোন এক সময় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানাধীন পশ্চিম রাজাবাজারের শাহজালাল প্রপার্টিজের নির্মিত রশিদ লজের ৫৮/এ/২ নম্বর ৬ তলা বাড়ির চতুর্থ তলার এ-৪ নম্বর ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বেসরকারী মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সরোয়ার হোসেন সাগর ও তার স্ত্রী বেসরকারী টেলিভিশন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনীকে। ওই সময় বাসায় সাগর-রুনীর একমাত্র ছেলে মেঘ ছিল। পরবর্তীতে তার মাধ্যমেই সাগর-রুনী হত্যাকা-ের বিষয়টি পরিবার জানতে পারে। এ ব্যাপারে শেরেবাংলা নগর থানায় রুনীর ভাই রুমান বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ১৯ মে হাইকোর্টের নির্দেশে বর্তমানে মামলাটি র‌্যাব তদন্ত করছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২৬ মে ভিসেরা আলামতের জন্য সাগর-রুনীর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। লাশ থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়। চাঞ্চল্যকর মামলাটির উন্নত তদন্তের জন্য ওই বছরের ১২ জুন প্রথম দফায় ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত হিসেবে জব্দ করা একটি ছুরি, ছুরির বাট, সাগরের জুতা-মোজাসহ পরনের প্যান্ট এবং রুনির পরনের প্যান্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফোকল্যান্ড ফরেনসিক ও ডিএনএ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ওই বছরের ১৭ জুলাই হত্যাকা-ের সময় যে কাপড় দিয়ে সাগরের হাত ও পা বাঁধা ছিল, সেই কাপড় এবং রুনির টি-শার্ট পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওই একই পরীক্ষাগারে। প্রথমদিকে হত্যাকা-ের অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে বাড়িটির নিরাপত্তারক্ষী হুমায়ুন কবির ওরফে এনামুল হককে (২৩) শনাক্ত করা হয়। তাকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এনামুল র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারও হয়। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে পাঠানো সব আলামতের পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্ট তাদের কাছে এসেছে। সেসব রিপোর্টের পর্যালোচনা চলছে। পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্য মোতাবেক মামলার তদন্ত এগোচ্ছে। মামলার বাদী নওশের আলম রুমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবারই আশার কথা শুনি। কিন্তু সে আশার কথা, বাস্তবে কবে রূপ নেবে তা অজানা। সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যাকা-ের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবিতে আজও প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন, মিছিলসহ নানান ধরনের কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কেন বছরের পর বছর ধরে সাংবাদিক হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারছে নাÑ সেই প্রশ্নের উত্তরও রহস্যের আড়ালে ঢাকা। সোহাগী জাহান তনু হত্যাকা- ॥ দীর্ঘ ৯ মাস অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকা-ের। এখনও রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ এ হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারার বিষয়টি নিয়েও দেখা দিয়েছে অনেক প্রশ্ন। চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনু হত্যাকা-ের শিকার হন। ওই রাতেই কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতরের ঝোপ থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। লাশের ময়নাতদন্ত হয় পর দিন। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা মির্জানগর গ্রামে দাফন করা হয়। ময়নাতদন্ত নিয়ে বির্তক শুরু হলে আদালতের নির্দেশে ২৮ মার্চ লাশ তুলে দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত হয়। পরবর্তী সময়ে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি। ওই সময় লাশ থেকে ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গত ১ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার সিআইডিতে স্থানান্তরিত হয়। গত মে মাসে ডিএনএ প্রতিবেদন হাতে পায় সিআইডি। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহমেদ। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, তনুর পোশাক থেকে ধর্ষণের আলামতসহ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত আলামতে তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই তিন ব্যক্তি কে, তা এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তদন্তের স্বার্থে তনুর মা-বাবাসহ পরিবারের অনেকের সঙ্গেই একাধিকবার কথা বলা হয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তনুর মা সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তির সঙ্গে আলামত হিসেবে পাওয়া ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন। যে তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা লাশ থেকে পাওয়া গেছে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তনুর মায়ের বক্তব্য মোতাবেক সন্দেহভাজন ওই তিন ব্যক্তি সর্ম্পকে নিশ্চিত হওয়ার পরই ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আদালত অনুমতি দিলে ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হবে। মামলাটির তদারক কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলার দায়িত্বে থাকা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ব্যারিস্টার মোশারফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মামলার তদন্ত সঠিকভাবেই এগোচ্ছে। তনুর পিতা মামলার বাদী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, তদন্তের কোন কিছুই ঠিক পাচ্ছি না। এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যা ॥ দীর্ঘ ৬ মাস অতিবাহিত হলেও পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকা-ের উদ্ঘাটনের কূলকিনারা হয়নি। যেভাবে তদন্ত করা হচ্ছে তাতে কবে হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটিত হবে তা নিয়েও দেখা দিয়েছে নানান প্রশ্ন। মিতু হত্যাকা-ের তদন্ত নিয়ে তার স্বামী বাবুল আক্তারকে নিয়ে যে টানাহেঁচড়া হয়েছেÑ তাতে জনমনে নানান ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এসব ঘটনা কি পুলিশ ইচ্ছা করেই করছে? গত ৫ জুন সকালে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে একমাত্র ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হন। একটি মোটরসাইকেলে তিন যুবক মিতুকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ঘটনার সময় এক হত্যাকারী মিতুর ছেলেকে একপাশে সরিয়ে রাখে। ঘটনার সময় এসপি পদে পদোন্নতি পাওয়া বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করতে এসেছিলেন। স্ত্রী হত্যার পর থেকেই তিনি রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর অঞ্চলের ২২০/এ নম্বর দোতলা বাড়িটিতে অবস্থান করছিলেন। এ ঘটনায় ব্যাপক অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার হয় ছাত্রশিবিরের সাবেক কর্মী আবু নসুর গুন্নুু (৪৬), ইব্রাহিম, শাহজামান ওরফে রবিন (২৮), নসুর, রবিন, জেএমবি সদস্য বুলবুল আহমেদ ওরফে ফুয়াদসহ অনেকেই। পরবর্তীতে দুইজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারাও যায়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেন নামে দু’জন হত্যাকা-ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে গত ২৬ জুন আদালতে জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসার নাম আসে। মুসা রাঙ্গুনিয়ার ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ হত্যাসহ ছয় মামলার আসামি। সে বাবুল আক্তারের সোর্স। মিতু হত্যাকা-ের অস্ত্রের যোগানদাতা হিসেবে গ্রেফতারকৃত এহতেশামুল হক ভোলাও পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের সোর্স হিসেবে পরিচিত। এদিকে বাবুল আক্তারকে গভীর রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে টানা প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করায় মিতু হত্যাকা-ের মোড় ঘুরে যায়। স্ত্রী হত্যাকা-ের সঙ্গে বাবুল আক্তার জড়িত বলে বিভিন্ন সময় প্রকাশ পায়। যদিও বাবুল আক্তার ও তার স্ত্রীর পরিবার এমন তথ্য ভিত্তিহীন বলে দাবি করে আসছে। সম্প্রতি বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ নিয়েও নানান গুঞ্জন আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জোরপূর্বক বাবুল আক্তারের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়েছে। পদত্যাগটি প্রত্যাহারের জন্য বাবুল আক্তার আবেদন করেছিলেন। যদিও পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি চাকরি করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকা-ের অগ্রগতি সর্ম্পকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ইকবাল বাহার জনকণ্ঠকে বলেন, আশা করছি স্বল্প সময়ের মধ্যেই মিতু হত্যাকা-ের অগ্রগতি হবে। পলাতক মূসাকে গ্রেফতার করতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। মূসাকে গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) একেএম শহীদুল হক বলেছেন, পুলিশ ইচ্ছা করলেই সব কিছু করতে পারে না। পুলিশের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রাজধানীর গুলশানে হোটেল আমারিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আয়োজনে এক মতবিনিময় সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি। গত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ডিএমপির যুগ্মকমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায়। শহীদুল হক বলেন, পুলিশেরও ভুলত্রুটি রয়েছে। তবে পুলিশ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। সকলের পরামর্শ নিয়ে আমরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে চাই। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মাসুদুর রহমান নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের চুরি যাওয়া ব্যাগ উদ্ধারের ঘটনা, আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া ধর্ষক রুবেলকে গ্রেফতারের উদাহরণ টেনে বলেন, পুলিশ প্রশাসনে অনেক দক্ষ, মেধাবী, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা আছেন; যারা অসংখ্য ক্লুলেস ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে দেখিয়েছেনÑ আমরাও পারি।
×