ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

বিপ্লবেরই রক্ত লাল ঝাণ্ডা ওড়ে আকাশে

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

বিপ্লবেরই রক্ত লাল ঝাণ্ডা ওড়ে আকাশে

শৃঙ্খল ভাঙ্গার গান গেয়েছিলেন তিনি। মুক্ত মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে যারা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সাম্য, মৈত্রীর বন্ধনকে অটুট রাখার জন্য নিরন্তর সাধনা করেছেন। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত জনতার জয় চেয়েছেন। আরও চেয়েছেন শোষিত মানুষের একতার জয়। বিপ্লবের স্পন্দনে কাঁপিয়ে তুলেছিলেন চরাচর। রাষ্ট্রের কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থে শ্রমিকের ঘাম কেড়ে নেয়ার দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছিলেন। স্বদেশের মানুষ খুঁজে পেয়েছিল তাদের জীবন ও কর্মের সারাৎসার অর্থ। দেশবাসী উপলব্ধি করে নিয়েছিল, এই সেই মাতৃভূমি তাদের; যেখানে তারা রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের স্বাধীনতা। লিখেছে নিজেদের শ্রমে ভাগ্য গড়ার কায়দা-কানুন। বিপ্লবের সংজ্ঞা তিনি দিয়েছিলেন বিপ্লবপরবর্তী সময়েও। বলেছিলেন, বিপ্লব মানে রাষ্ট্রকে প্রতিদিন নাগরিক ইচ্ছার সামনে নির্বাচনের পরীক্ষা দেয়া। বিপ্লব মানে প্রতিনিয়ত জনমতকে ধারণ করা। সফল বিপ্লবী বলেই জীবদ্দশায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন কিংবদন্তি মানবে। স্বদেশের নিরন্ন, দরিদ্র বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য জীবনভর ছিলেন নিবেদিত। শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত শ্রমজীবীদের জীবনে তিনি নিয়ে এসেছিলেন মুক্তির বারতা। সবদিক দিয়েই তিনি দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলেন। পরগাছার জন্য শ্রমিকরা যেখানে আর শ্রম দিতে বাধ্য ছিল না। প্রথম জীবনে একজন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা ও পরে বিপ্লবী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করে বিশ্বজুড়ে নজির স্থাপন করার গৌরব তিনি অর্জন করেছিলেন। মার্কিন প্রভাবিত তার দেশটিতে অন্যায়-অবিচারের বিস্তার এমনই ছিল যে মানুষ সেই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিল। তিনি বিকল্পপথে বিপ্লবের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরশাসকের কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে কিউবার বিপ্লবীরা দেশটির যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একনায়ক বাতিস্তাকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে। এরপর প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কিউবার প্রধানমন্ত্রী ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থেকে কিউবাকে বের করে নিয়ে এসে বিশ্বমানের স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার কারণে তিনি নিজ দেশসহ বিশ্বে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। ২০০৮ সালে অনুজের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া বিশ শতকের সফল সংগ্রামী ও বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো। গাল ভরা দাড়ি। মুখে হাভানা চুরুট। সামরিক পোশাকে চলাফেরা; মুখে তার সেøাগান হয় সাম্যবাদ, নয় মৃত্যুÑ এমন দৃশ্যপট গেঁথে আছে আজও বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষের চোখে। বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র জাতি ও দেশ হয়ে কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয়, তা শিখিয়ে গেছেন তিনি। স্বদেশের শাসকগোষ্ঠী তাকে গ্রেফতারের পর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেনÑ ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে। এ বক্তব্যের পর তাকে ক্ষমা করা হলে তিনি নির্বাসনে যান এবং মুক্তিকামী মানুষদের সংগঠিত করেন বিপ্লবের পথে। বিপ্লবেরই রক্ত লাল ঝা-া তিনি উড়িয়েছিলেন আকাশে। আর ইতিহাস তাকে সকল গ্লানি থেকে মুক্ত করে। শত্রুপক্ষের অজস্র অপপ্রচার তাকে কাবু করতে পারেনি। সর্বহারার জয়ধ্বনি তিনি বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সাহসের বরাভয় কাঁধে। তাকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সবই ব্যর্থতায় পরিণত হয়। শুধু হত্যার চেষ্টাই নয়, তার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য বহু অপচেষ্টাও চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ব্রিটিশ চ্যানেল ফোর কাস্ট্রোকে হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে ‘৬৩৮ ওয়েজ টু কিল কাস্ট্রো’ নামে যে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করে, তা বিশ্ববাসীকে হতবাকই করেছে। কারও কাছে মাথা নত না করার যে শিক্ষা তিনি জীবনভর ধারণ করেছেন, তা সম্প্রসারিত করেছেন অন্যদের মাঝেও। বিশ্বের যেখানে স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেখানেই তিনি বাড়িয়েছেন সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থনের হাত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অসামান্য ভূমিকা কিউবার এই বিপ্লবী নেতার। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে শ্রদ্ধা জানাতে জাতির পিতার কন্যা ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিদেলকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করেছেন ২০১৩ সালে। মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয় কাস্ট্রোকে। বার্ধক্য ও অসুস্থার কারণে সম্মাননা নিতে আসতে পারেননি। তবে তার পক্ষ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন কিউবার রাষ্ট্রদূত আবেলার্দো কুয়েতো। মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ‘কিউবার পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হতো। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে কার্যত বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল উষ্ণ। আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য ছিল উঁচুমাত্রার। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়েও বিভিন্ন দুর্যোগে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে।’ এই কিউবার জন্য মার্কিন প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ১৯৭৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বহু মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল। কিউবায় চটের বস্তা রফতানি করার খেসারত দিতে হয়েছিল বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধকালীন বৈরিতার জেরে দীর্ঘ সময় দেশটির সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক ছিল অস্থির, টানাপোড়েনে জর্জরিত। বিশ্ব মানচিত্রে এখনও কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে কিউবা নিজের শক্ত অবস্থানকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বহু বাধা-বিপত্তির পরও। প্রবল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়া দুটো সমাজÑ কিউবা ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল কিউবার নেতার সঙ্গে, ফিদেল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তাঁর সিদ্ধান্ত; অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল কিউবা। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র মুুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বৈরী দেশ। ১৯৭২ সালে কিউবা ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বাংলাদেশকে প্রথম দিকে স্বীকৃতিদাতা দেশগুলোর মধ্যে কিউবা ছিল অন্যতম। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর দুই বছর খরায় আউশ ও আমনের ফসলের চরম ক্ষতি হয়। ১৯৭৪ সালে দেখা দেয় বন্যা। একদিকে যুদ্ধাকালীন ক্ষয়ক্ষতি। অপরদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর সঙ্গে জড়িত হয় ফড়িয়া ও চোরাকারবারিদের সীমাহীন অর্থলিপ্সা। উপরন্তু চরমপন্থী, উগ্রপন্থী, স্বাধীনতায় পরাজিত শক্তি, দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র সহিংস কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়ায় দেশে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে দুষ্প্রাপ্যতাও। সব মিলে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুর্ভিক্ষ-যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবেলা করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের ক্ষত শুকানোর আগেই প্রকৃতির রুদ্ররোষে কাবু তখন দেশ। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশের প্রায় সর্বত্র প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলসমূহ বন্যায় প্লাবিত হয় এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৪ সালের শুরু থেকেই দেশে খাদ্যাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ১৯৭৩ সালে প্রথম অনাবৃষ্টিতে এবং পরে বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেশে এখাদ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ। এই বছর একই কারণে ভারতেও খাদ্য ঘাটতি হয়েছিল। এই পরিস্থিতি পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইইসি সদস্যভুক্ত কয়েকটি দেশও অষ্ট্রেলিয়া থেকে পর্যাপ্ত খাদ্য আমদানি করার জন্যে। কিন্তু চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি এবং দুষ্কৃতকারীদের খাদ্য গুদামে অগ্নিসংযোগ ও খাদ্য বহনকারী ট্রাক, ট্রেন ও জাহাজ ধ্বংস করার মতো অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ দেশে সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস দুটোতে বাংলাদেশের জনজীবনে এক নজিরবিহীন খাদ্য-বস্ত্র ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দুষ্প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্যজনিত বিপর্যয়ের পাশাপাশি নেমে আসা আর এক অভিশাপ- সর্বনাশা বন্যা। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। ঢাকার বিভিন্ন বিদেশী মিশন ও দূতাবাস বন্যার ধ্বংসলীলার সংবাদে উদ্বেগ প্রকাশ করে। বন্যায় ফসল মার খেল প্রায় ১০ লাখ টন। বিশ্বজুড়ে তখন মন্দাভাব। খাদ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোয় উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সারাবিশ্বে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে বিশ্ববাজারে সব পণ্যের দামই তখন চড়া। বেশি দামে খাদ্য কিনে সঙ্কট মোকাবেলার মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না সরকারী কোষাগারে। রফতানি আয়ের একমাত্র উৎস তখন পাট। তাতেও মন্দাভাব। সত্তর দশকে বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এটাও বলেছিল বঞ্চিত-বুভুক্ষু বিশ্বের এক শ’ কোটি মানুষ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বোঝা। জাতিসংঘ অবশ্য সুপারিশ করেছিল, ধনী দেশগুলো তাদের জাতীয় উৎপাদনের (জিএনপি) শতকরা শূন্য দশমিক সাতভাগ বঞ্চিত- বুভুক্ষু দেশগুলোতে নিয়োগ করুন। এর আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ঘোষণা করেছিলেন, তার সরকার যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ কাজে পুরো শক্তি নিয়োগ করেছে। বঞ্চিত বুভুক্ষু মানুষের দেশে অর্থ সাহায্য বাড়াতে পারবে না। জাতিসংঘের প্রস্তাবটি প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই সে সময়ের বিশ্বের দ্বিতীয় ঐশ্বর্যশালী অঞ্চল ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন (ইইসি) জোট তাদের জিএনপি’র শতকরা শূন্য দশমিক এক ভাগ ও নিয়োগ করতে রাজি হয়নি। তবু বাংলাদেশ সে বছর ৭৩২ কোটি টাকার খাদ্য শস্য আমদানি করেছিল। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খাদ্য সাহায্যের জন্য আবেদনও করে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে আসে অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন জানতে পারে, বাংলাদেশ কিউবার কাছে চটের ব্যাগ বিক্রি করছে। মার্কিন খাদ্য সাহায্য আইন পিএল ৪৮০ অনুসারে যে দেশ কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করছে, সে দেশ খাদ্য সাহায্যের জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন নয়। বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন মাত্র একবারের জন্য ৫০ লাখ ডলারের বিনিময়ে ৪০ লাখ চটের ব্যাগ বিক্রি করে কিউবার কাছে। কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী কোন বাণিজ্যিক চুক্তি হয়নি। নিয়মিত কোন ব্যবসা-বাণিজ্যও গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু মার্কিন আইনের এমন বিধান সম্পর্কে বাংলাদেশ অবহিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, বাংলাদেশ যদি এ মর্মে ঘোষণা দেয়, ভবিষ্যতে কিউবার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করে দেবে, তাহলে খাদ্য সাহায্যের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দাবিটি মেনে নেয়। এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের চরম দিন ক্রমশ মৃত্যুমুখী করে তুলেছিল মানুষকে। যদিও বঙ্গবন্ধুর সরকার খাদ্য ঘাটতি পূরণে ৭৪ সালের শুরুতেই অষ্ট্রেলিয়া, ইইসি সদস্যভুক্ত দেশ, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্য ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করেছিল। চলতি বাজার দরেই এসব খাদ্য ও পণ্য কেনার কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ না করায়, এমনকি নগদ টাকার বিনিময়েও খাদ্য জাহাজ পৌঁছে না দেয়ার ফলেই দুর্ভিক্ষ তীব্রতর হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছানোর জন্য স্থিরকৃত দুটো বড় চালানের বিক্রয় বাতিল করে। বাংলাদেশ বহু চেষ্টা করেও মার্কিন সরকারের সহায়তা লাভে ব্যর্থ হয়। দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে সেদিন যারা মারা গিয়েছিল, তাদের প্রতি সামান্য অনুকম্পা দেখায়নি যুক্তরাষ্ট্র। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ তারা নিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার সেনাদের গণহত্যার পর আরও মানুষ হত্যা করার বন্দোবস্ত করে। যুক্তরাষ্ট্র সেদিন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে সাধারণ মানুষকে না খেয়ে মরতে হতো না। ফিদেলের মৃত্যু বাংলাদেশকেও শোকাভারাতুর করেছে। মুক্তিকামী বাঙালীর জীবনে তিনি প্রতিভাত হবেন এক মহান মানবে। শেষ বিদায় কাস্ট্রো।
×