ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কলাপাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয়হারাদের জন্য নির্মিত

জীর্ণদশায় হাজার হাজার ঘর

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

জীর্ণদশায় হাজার হাজার ঘর

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২৭ নবেম্বর ॥ কলাপাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি হারানো আশ্রয়হারা হতদরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনে সরকারী এবং বেসরকারীভাবে নির্মিত হাজার হাজার ঘর এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। জীর্ণদশার কারণে এসব ঘরে আশ্রিত হাজারো পরিবার পুনর্বাসনের ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে আবার বেড়িবাঁধের সেøাপে কিংবা এক চিলতে খাস জমিতে ঝুপড়ি তুলে চরম দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকছেন। ফলে ফের আশ্রয়হারা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আর পুনর্বাসনের এসব ঘর খালি পড়ে আছে। এমনকি এসব ঘরের টিন-চাল-বেড়া খুলে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। যথাযথ তদারকির অভাব এবং শ্রমজীবী মানুষের জন্য এসব ঘর বসবাসের উপযোগী না হওয়ায় একদিকে ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয় নেয়ার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। এদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সরকারের উদ্যোগে ৬৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষুদ্রঋণ সরকারী উদ্যোগে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০১৩ সালে। মাত্র তিনটি আবাসন প্রকল্পের বাসিন্দাদের জন্য প্রায় ২২ লাখ টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। বাকি টাকা ব্যাংকে অলস পড়ে আছে। শুধুমাত্র যথাযথ তদারকির অভাবে দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করার সরকারের এ যুগান্তকারী উদ্যোগ এখন ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ এসব পরিবারের সদস্যরা কোন উপায় না পেয়ে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রকৃতির বুলডোজারখ্যাত ঘূর্ণিঝড় সিডর বিধ্বস্তে উপকূলীয় কলাপাড়ায় ১২ হাজার নয় শ’ পরিবার গৃহহারা হয়ে পড়ে। এসব পরিবারকে আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের আবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ঠিকানাহারা এসব মানুষকে পুনর্বাসনে সরকারীভাবে আবাসন, বিশেষ আবাসন, জাপানী ব্যারাক হাউস, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিয়নে দেড় শতাধিক ব্যারাক হাউস করা হয়, যেখানে প্রায় দুই হাজার পরিবারের আশ্রয়স্থল করা হয়। এছাড়া বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে পাঁচ হাজার পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়। ২০০৭ সালের সিডরপরবর্তী সময় থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পুনর্বাসনের কাজ চলতে থাকে। কিন্তু তিন বছর না যেতেই এসব ঘরের এখন ব্যবহার উপযোগিতা নেই। টিনের চাল মহাসেনে উড়ে গেছে। কোথাও আবার স্থানীয় লোকজন খুলে নিয়ে গেছে আবাসন ব্যারাকের বেড়া কিংবা চাল। প্রভাবশালীসহ যারা আবার ওই সব আবাসনে বসবাস করছে তারা একেকজনে একাধিক ব্যারাক দখল করে গবাদিপশু পালন করছে। আবার দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের কর্মস্থলের অনেক দূরে কিংবা বিরোধীয় খাস জমিতে এসব আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে। মোটকথা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার ছিন্নমূল শ্রমজীবী মানুষকে আশ্রয়স্থল করে দিলেও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ তদারকির অভাবে সকল উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছে। এসব মানুষকে একটু ঠিকানার জন্য সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল। শুধু আশ্রয়স্থল নয়, আয়বর্ধনমূলক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলে ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার প্রক্রিয়াও চালু করা হয়। কিন্তু সবই যেন ভেস্তে যাচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে এসব পুনর্বাসনের বেহালদশার ভয়াবহতার চিত্র। চাকামইয়া ইউনিয়নের গামুরি বুনিয়ায় ২০০৮ সালে এক শ’ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১০টি টিনশেড ব্যারাক করে দেয়া হয়। মনোরম পরিবেশ ইউ টাইপে তিন দিকে ব্যারাক হাউস, মাঝখানে একটি বিশাল পুকুর। দক্ষিণ দিকে একটি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে, যেখানে আবাসনে বসবাসকারীদের সন্তানরা লেখপড়া করার সুযোগ পাবে। পুকুরটিতে সমবায় সমিতির মাধ্যমে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা। কিন্তু সব বেহালদশা। ১০ নম্বর ব্যারাকের ৭ নম্বর কক্ষের সালমা-বাদল হাওলাদার দম্পতি জানালেন, পাঁচ বছর আগে তারা এখানে উঠেছেন। বর্তমানে থাকার উপায় নেই। চাল উড়ে গেছে মহাসেনে। একই ব্যারাকের চারটি কক্ষ বর্তমানে খালি পড়ে আছে। ৭ নম্বর ব্যারাকের ৯ নম্বর কক্ষে থাকছেন রাবেয়া-আলফাজ দম্পতি। তাদের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ থাকলেও তারা থাকছেন তিনটি কক্ষ দখল করে। ৬ নম্বর ব্যারাকের ৮টি কক্ষ খালি পড়ে আছে। বেড়ার টিন উধাও হয়ে গেছে এসব কক্ষের। ওই ব্যারাকের তিনটি কক্ষ এখন ব্যবহার হচ্ছে গবাদিপশুর জন্য। ময়লা-আবর্জনায় একাকার হয়ে আছে। ৫ নম্বর ব্যারাকের ১০টি কক্ষের চারটি খালি পড়ে আছে। এভাবে এখানকার ১০টি ব্যারাকের ১০০ কক্ষের অন্তত ৬০টি খালি পড়ে আছে। ৩ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা তারা বানু জানালেন, তাদের সরকারী উদ্যোগে কোন সহায়তা দেয়া হয়নি। একই অবস্থা চরধুলাসারের দুটি ব্যারাকের। ২০ কক্ষের মাত্র ১২টিতে লোকজন থাকছে। বাকিসব খালি রয়েছে। চরচাপলীর তিনটি ব্যারাকের ৩০ কক্ষের ২১টি খালি পড়ে আছে। একটি ব্যারাকের চাল-বেড়া খুলে নেয়া হয়েছে। আইয়মপাড়া গ্রামের আবাসনের ব্যারাকটিতে বসবাসকারীদের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘর বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। অথচ এরই মধ্যে ব্যারাকের টিন-চাল জীর্ণদশায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। লোহার এ্যাঙ্গেলগুলো ভেঙ্গে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ছে। সামনের টয়লেট ব্যবহার করা যায় না। মেলাপাড়া গ্রামের আবাসনটি করা হয়েছে মাত্র দুই বছর আগে। অথচ অধিকাংশ ঘরের বেড়া কিংবা চালের টিন নষ্ট হয়ে গেছে। নদীরপাড়ে হওয়ায় জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প রয়েছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নীলগঞ্জ গ্রামের নদীর পাড়ে। এখানে ২৮টি ব্যারাকে ২৮০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কলাপাড়া শহরের উল্টোদিকে হওয়ায় এখানে সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবী মানুষ বাস করছে। এসব পরিবারের সদস্যদের সমবায়ের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ। কিন্তু কোনটাই সফলতায় পৌঁছেনি। ঘরগুলো জীর্ণ হয়ে গেছে। যাদের ঘর দেয়া হয়েছে তাদের অনেকে আবার এই ঘর টাকার বিনিময়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে। কয়েকটি ঘর আবার মাদক ব্যবসায়ীরা দখল করে রমরমা মাদকের কারবার করে আসছে। এই ব্যারাকে চলছে অপরাধমূলক কর্মকা-। সবচেয়ে বেশি বেহালদশা চালিতাবুনিয়া আবাসনের। এখানে ১০টি ব্যারাকের এক শ’ কক্ষের মধ্যে মাত্র ৯টিতে লোক বসবাস করছে। বাকিসব খালি পড়ে আছে। খালি ঘরগুলো এখন গোয়ালঘরে পরিণত হয়েছে। বেড়া-টিন উধাও হয়ে গেছে। একই দশা চাকামইয়া নিশানবাড়িয়া, খাজুরা, ফাঁসিপাড়া, পাখিমারা গুচ্ছগ্রামের, আনিপাড়া, লেমুপাড়া, লোন্দা, ছোট বালিয়াতলী, তেগাছিয়া, ফতেহপুর আশ্রয়ণ কিংবা আদর্শ গ্রামের। মোটকথা আবাসন, আশ্রয়ণ কিংবা আদর্শ গ্রাম সবগুলোর এখন চরম বেহালদশা। বসবাস উপযোগিতা নেই। এসব প্রকল্প সরকারী অর্থায়নে করা হয়েছে। সরকারী হিসাবে কলাপাড়ায় অন্তত ১৭০টি ব্যারাক হাউস করা হয়েছে। এছাড়া গুচ্ছগ্রাম ও আদর্শ গ্রাম করা হয়েছে আরও দশটি, যেখানে কমপক্ষে দুই হাজার পরিবারের আবাসস্থল রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় দেড় হাজার পরিবার বসবাস করছে। কিন্তু কাগজপত্রে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ৪৯৭ পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও রাখাইনদের জন্য তিনটি বিশেষ আবাসন করা হয়েছে, যেখানে ৫৭ পরিবার বসবাস করছে। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম সাদিকুর রহমান জানান, ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ছিন্নমূলদের মধ্যে আবাসনের ঘরগুলো বরাদ্দ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এরপরেই কর্মসংস্থানের জন্য আয়বর্ধনমূলক কাজে সহায়তার জন্য ঋণ প্রোগ্রাম চালু করা হবে।
×