ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের  বিচিত্র কর্মজীবন

চতুর্থ অধ্যায় মহামান্য ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব উদ্্যাপন (গতকালের পর) একটি বড় প্রশ্ন হলো যে, অতিথিদের জন্য কি ধরনের গাড়ির ব্যবস্থা হবে। তারা বলেন যে, দুটি কনভার্টিবল গাড়ির প্রয়োজন আছে এবং দুই শহরেই সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র দুটি কনভার্টিবল গাড়ি ছিল- একটি ঢাকার নবাব হাসান আসকারীর এবং অন্যটি ব্যবহারজীবী রেজা-ই-করিমের। সরকারী সিদ্ধান্ত হলো যে আর একটি কনভার্টিবল গাড়ি আমদানি করা হবে। কিন্তু চট্টগ্রামে একটি কনভার্টিবল গাড়িরই ব্যবস্থা হবে। চট্টগ্রামে রানীর শুধু একটিই অনুষ্ঠান ছিল। আর তা ছিল চট্টগ্রামের পুরনো সার্কিট হাউসে সুধী সমাজের সঙ্গে একটি স্বল্প সময়ের বৈঠক। চট্টগ্রামে রানী সকাল বেলা গেলেন এবং অপরাহ্নে প্রত্যাবর্তন করলেন। প্রটোকলের দায়িত্ব সরেজমিনে অবলোকন করার জন্য আমাকে করাচী যেতে হলো। রানী প্রথম করাচীতে আসলেন তারপর লাহোর হয়ে ঢাকায় আসলেন। এয়ার কমোডর রব খুব খোশমেজাজের মানুষ ছিলেন। দেখতে শুনতেও ছিলেন লম্বা ও দুরস্ত। তিনি আমাকে বিশেষভাবে কতিপয় আনুষ্ঠানিকতা ভাল করে দেখতে বললেন। মহামান্য রানীর সঙ্গে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীও সহযাত্রী ছিলেন। এদের দেখাশোনার দিকে বিশেষ নজর দিতে তিনি আমাকে সাবধান করে দিলেন। করাচী থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলাম। আমি ঠিক করলাম যে রানীর অভ্যর্থনার জন্য আমার কিছু সহযোগী লাগবে। তাই আমি প্রস্তাব করলাম যে, আমি কতিপয় যুবক কর্মকর্তাকে মহকুমা থেকে ডেকে এনে তাদের মেজবান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেব। তদনুযায়ী প্রায় ১০-১২ জন স্মার্ট কর্মকর্তাকে (যাদের মধ্যে ঢাকা থেকেও দু’একজন ছিলেন) ঢাকায় রানীর আগমনের দু’দিন আগে এনে তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে অবহিত করা হলো। লাট সাহেবের উদ্যোগে আমরা রানীর পুরো আগমন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান পর্বের একটি পূর্ণ রিহার্সালও করলাম। ১৫ ফেব্রুয়ারিতে রানীর নিজস্ব বিমান পোত ঢাকায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করল; পেছনে ডিউক অব এডিনবরার স্বতন্ত্র একটি বিমানও আসল। অবশ্যি রানীর বিমানেই ডিউক আসলেন। তার প্রত্যাগমনের ভ্রমণসূচীটি ছিল আলাদা, তাই ফেরত পথে তিনি তার বিমানে অন্যত্র গেলেন। বিমানপোতে সংবর্ধনা ও সামরিক সালাম শেষ করে মহামান্য রানীর সঙ্গে অভ্যর্থনার জন্য যেসব সম্মানিত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন তাদের সঙ্গে অতিথি দু’জনকে লাট সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। লাট সাহেবের হুকুম ছিল, আমি যেন সব সময় কাছাকাছি থাকি। মহামান্য ডিউক কিন্তু খানিকটা অভদ্রতা করে অভ্যর্থনা লাইনের ব্যক্তিবর্গকে খানিক পরে পরেই প্রশ্ন করলেন, ‘অৎব ুড়ঁ ধ ংড়হ ড়ভ ঃযব ংড়রষ’ মনে হলো তিনি পূর্ব বাংলায় পরবাসী শাসনের বিরুদ্ধে যে হতাশা ও ক্রোধ ছিল সেটা সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। এই পর্বের শেষে সজ্জিত শকটে একটুখানি রাস্তা অতিক্রম করে আস্তে আস্তে অতিথি ভবনে আসতে খুব কম সময়ই লাগল, সারাটি রাস্তার দু’পাশে ছিল জনগণ এবং নানা নিশানের খেলা। আমি মহামান্য ডিউকের গাড়িতে উপবিষ্ট ছিলাম। রানীর গাড়িতে ছিলেন স্বয়ং লাট সাহেব। গাড়ি থেকে নেমে অবসর সময় ছিল মাত্র দু’ঘণ্টা। তারপরই কাছে রমনা মাঠে ছিল জনসংবর্ধনা। গাড়ি থেকে নেমেই মহামান্য ডিউক আমাকে জানিয়ে দিলেন যে, উন্মুক্ত কনভার্টিবলের কি হয়েছে? নবাব বাহাদুরের গাড়ি কোথায়? বলে দিলেন, ওই কনভার্টিবল না আনলে তিনি সংবর্ধনা সভায় যাবেন না। আমি তার নির্দেশনায় বেশ খুশি হয়ে গাড়িচালকের খোঁজে নামলাম। আমাকে বেশি খুঁজতে হলো না, কারণ নবাব সাহেবের শকটচালক সুন্দর সাজসজ্জা করে কাছেই ঘুরঘুর করছিল। তার গাড়িতেই ডিউকের উঠার কথা ছিল তবে সে ব্যবস্থা নাকচেরও একটি মজার কাহিনী আছে। সে ডিউকের ইচ্ছার খবর পেয়ে নিয়ম মাফিক তার গাড়ি শকট শোভাযাত্রার যথাস্থানে (অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানে) নিয়ে আসল। এই শকটচালক কিছুদিন আগে (সম্ভবত এক বছরের কম সময়) যখন ডিউক তার প্রথম ঢাকা ভ্রমণে আসেন তখন তার শকটচালক ছিল। ডিউক তখন এসেছিলেন পাকিস্তান এ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স সম্মেলনের সম্মানিত অতিথি হিসেবে। সমগ্র ভ্রমণসূচী নিয়ে আমাদের সমস্যা ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বড় কর্তা এঙঈ সাহেব যার নাম ছিল মেজর জেনারেল আবদুর রহিম খান। তিনি ছিলেন উচ্চ রক্তচাপের রোগী এবং তাকে ঢাকায় পরীক্ষামূলক নিযুক্তি দেয়া হয়। তিনি ভাল করলে চাকরিতে বহাল থাকবেন, অন্যথায় অবসর পাবেন। তিনি ঢাকার দায়িত্ব শেষে অবসরে যান। নবাব বাহাদুরের গাড়ি ছিল একটি পুরনো শেভরেলট এবং মাঝে মাঝে স্টার্ট নিতে দেরি করত। জেনারেল রহিম সেই রকম অবস্থায় গাড়িটি দেখেন যখন গাড়িটি স্টার্ট দিতে দেরি করছিল, সঙ্গে সঙ্গে তিনি এই গাড়িটিকে শকট শোভাযাত্রায় তার যথাস্থান থেকে বিদায় করে দেন। তার এই নির্দেশ দেবার কোন অধিকার বা এখতিয়ার ছিল না। তাই মহামান্য ডিউকের হুকুমে যখন শকট শোভাযাত্রার মূল ব্যবস্থায় আমরা ফিরে গেলাম তখন আমি সবিশেষ সন্তুষ্টি লাভ করি। এই জেনারেল সাহেবের চটা মেজাজ এবং আকস্মিক সব সিদ্ধান্ত আমার মোটেই পছন্দ হতো না। সম্ভবত তার উচ্চ রক্তচাপের কারণে তার ব্যবহারটি ছিল হঠাৎ হঠাৎ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ঢাকায় নিযুক্ত ছিলেন, তাই তার বদরাগী ব্যবহার আমাদের বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি। আমরা সামান্য বিরতির পর রমনা পার্কের নাগরিক সংবর্ধনার পথে রওনা হলাম। মহামান্য ডিউক তার পরিচিত শকটচালক পেয়ে বেশ খুশিই হলেন। সংবর্ধনার বড় বিষয় ছিল মানপত্র পাঠ, রানীর বক্তৃতা এবং নাগরিকদের তরফ থেকে রানীকে উপহার প্রদান। কে মানপত্র পাঠ করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগল। ঢাকা রেডিওতে তখন আমার হবু স্ত্রী সাবিয়া বেগম তার পাঠের বিশুদ্ধতার জন্য খুব পরিচিত ছিল। তার নাম উঠল, তবে তাতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আসতে পারে বলে সে প্রস্তাব বাতিল হলো। তখন বেগম খোরশেদী আলমকে (উচ্চ শিক্ষিত ব্যবসায়ী ইফতেখারুল আলম কিচলুর স্ত্রী) এই মানপত্র পাঠের জন্য অনুরোধ করা হলো। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দু’বছরের সিনিয়র হিসেবে বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। রেডিও প্রোগ্রামে তিনি সুন্দরভাবে বাংলা পাঠ করতেন এবং নাটকে অভিনয় করতেন। উপহার প্রদান নিয়ে আর এক প্রশ্ন উঠল। সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হলো যে, আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী কোন শিল্পকর্ম তাকে দেয়া যায়। পটুয়া কামরুল ইসলাম সেই শিল্পকর্ম হিসেবে কোন মৃৎশিল্প বা সোনারূপার পণ্য দিতে সিদ্ধান্ত নিলেন। তার কলকাতা জীবনের একজন উর্দু ভাষাভাষী বাঙালী বন্ধু (তার নাম ভুলে গিয়েছি) যিনি ছিলেন দেশী শিল্পকর্মের শৌখিন সংগ্রাহক তিনি তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে একটি পুরনো রৌপ্যকর্ম রানীকে উপহার দিতে প্রস্তাব করলেন। নাগরিক সংবর্ধনায় প্রায় আড়াই শো বছরের পুরনো ঢাকার সোনারূপা শিল্পীদের সৃষ্টি একটি সুদৃশ্য আতরদান উপহার হিসেবে মহামান্য রানীকে প্রদান করা হয়। চলবে...
×