ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১৩টির অবস্থান মাঝামাঝি মানের

‘রেড’ জোনে ১৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

‘রেড’ জোনে ১৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

রহিম শেখ ॥ নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) বেশিরভাগের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এ তালিকার ৩৩টি প্রতিষ্ঠান গত জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ৪৯ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়নে ৩১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিই ‘রেড’ জোনে চলে গেছে; অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা খারাপ। আর ১২টির অবস্থান মাঝামাঝি মানের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ত্রৈমাসিক আর্থিক ঝুঁকি মূল্যায়ন’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকের পর এবার আর্থিক খাতেও লুটপাট চলছে। অর্ধেকেরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ। তারা নাজুক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার পক্ষে মত দেন। জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকি করতে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে যারা ভাল করছে তাদের গ্রিন জোনে, যারা মাঝারি মানের তাদের ইয়েলো জোনে এবং যাদের অবস্থা খারাপ তাদের রেড জোনে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ সামলানোর সক্ষমতা পরীক্ষা বা স্ট্রেস টেস্টিং রেটিংয়ে ১৫ প্রতিষ্ঠান ‘রেড জোনে’ ঢুকেছে। সব ধরনের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে এ রেটিং করা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এছাড়া ‘ইয়েলো জোনে’ পড়েছে ১৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ‘গ্রিন জোনে’ ৫ প্রতিষ্ঠান। গত মার্চে রেড জোনে ছিল ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ডিসেম্বরে ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৪ সালের জুনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপী ঋণ ছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের জুনে তা বেড়ে হয় ৩ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। গত মার্চে খেলাপী ঋণ ছিল ৪ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপী ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপী ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ নয়। তবে যেগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ এবং দুর্নীতি ও লুটপাট বেশি হয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরাই নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ বের করে নিয়েছেন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিছু কর্মকর্তা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বদলে ভূমিকা রেখেছেন। জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়মের কারণে পিপলস লিজিং এ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ও ফার্স্ট ফিন্যান্সে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের তিন কর্মকর্তা এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভা, অডিট সভায় উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। এর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ে নিযুক্ত পর্যবেক্ষক বেশ কিছু ঋণের বিষয়ে আপত্তি তোলায় তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ফলে এসব পর্যবেক্ষকও এখন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না, যাতে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মফিজউদ্দিন সরকার বলেন, তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণ খেলাপী করে দিয়েছে। ফলে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। মফিজউদ্দিন সরকার বলেন, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপী ঋণ কিছুটা বেড়েছে। যেসব ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছিল, তার কয়েকটি খেলাপী হয়ে গেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে খেলাপী ঋণ বেড়েছে। সূত্র বলছে, তিনটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, যার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান তিনটির মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ৫৮৫ কোটি, পিপলস লিজিংয়ের প্রায় ৪০০ কোটি ও ফার্স্ট ফিন্যান্সের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার এ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ খেলাপী হয়ে গেছে। সঙ্কট উত্তরণে তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক বসিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআইএফসির সাবেক এমডি এনামুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমি এখন আর ওই প্রতিষ্ঠানে নেই। তাই কোন মন্তব্য করতে পারব না। বিভিন্ন নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত বে লিজিং এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ঋণ বিতরণ করেছে ৭৪০ কোটি টাকা। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১৫ কোটি টাকা। একইভাবে ইসলামিক ফিন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ৮০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপী হয়েছে ৭০ কোটি টাকা, রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপী হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা, উত্তরা ফিন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে ১৭৫ কোটি টাকা খেলাপী ও বাংলাদেশ ফিন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপী হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। জানা গেছে, সর্বশেষ পর্যবেক্ষকের আওতায় আসা ফার্স্ট লিজ ফিন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১৩ কোটি টাকা মুনাফা করলেও ২০১৪ সালে মুনাফা কমে হয় ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে মুনাফা কমে হয়েছে মাত্র ৯০ লাখ। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপী ঋণ ১৫৮ কোটি টাকা হলেও ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ৩৫৯ কোটি টাকা। এর ফলে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৮ কোটি টাকা লোকসান করে ফার্স্ট ফিন্যান্স। ২০১৪ সালে প্রথম ছয় মাসে সাড়ে ৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন অনুযায়ী ফার্স্ট ফিন্যান্সে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে উদ্যোক্তাদের চাপে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএ মতিন ২৫ সেপ্টেম্বর হঠাৎ পদত্যাগপত্র জমা দেন। তার চুক্তির মেয়াদ ছিল ডিসেম্বর পর্যন্ত। এদিকে নিজেদের পছন্দের লোকজন নিয়োগ দিতে ইসলামিক ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (আইএফআইএল) পরিচালনা পর্ষদ ৪৯ জন কর্মকর্তা ছাঁটাই করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একজন পরিচালকের নিয়োগ করা ফার্ম ‘বিজনেস প্রফেশনালস এ্যান্ড কন্সালটেন্ট’ দ্বারা কর্মীদের মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়া হয়। পরে মূল্যায়নের পর উল্লিখিত কর্মকর্তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং অনেকের বেতন ভাতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ইসলামিক ফাইন্যান্সের কিছু কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে নীতি বহির্ভূতভাবে কর্মী ছাঁটাই, হয়রানি ও কোম্পানীটির নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সাধারণ কমকর্তাবৃন্দ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, দু-একটা প্রতিষ্ঠানে ঋণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গরমিল হয়েছে। যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের তদারকের মধ্যে রাখার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। ফলে আমাদের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
×