ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব

সরোদের সুরমূর্ছনায় শুরু, খেয়ালের অনুরণনে শেষ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

সরোদের সুরমূর্ছনায় শুরু, খেয়ালের অনুরণনে শেষ

মনোয়ার হোসেন ॥ শত বিড়ম্বনার শহর ঢাকায় চলছে সঙ্গীতের এক মহাযজ্ঞ। সেই সুরের নির্যাসে অবসাদগ্রস্ত নাগরিক মন প্রফুল্লতায় ভরে উঠছে। ধ্রুপদী সঙ্গীতের মোহময়তায় শহরবাসী খুঁজে নিচ্ছে আনন্দের উৎস। শাস্ত্রীয় আঙ্গিকের নাচের মুদ্রায়, সুরের আবাহনে কিংবা যন্ত্রসঙ্গীতের সুরতরঙ্গে মিটিয়ে নিচ্ছে মনের খোরাক। সঙ্গীতের সাতটি স্বর উপলব্ধির পাশাপাশি বহুমাত্রিক আনন্দের সঞ্চার করেছে এ উৎসব। গান শুনতে শুনতে চলছে নির্মল আড্ডা, বন্ধু বা স্বজনরা মিলে ফুড কোর্টে চলছে জমিয়ে আহার, রকমারি বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী দেখা, ব্যানারে মেলে ধরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপালদের ছবি বা আগামীর নিসর্গের ঢাকার রূপরেখা অবলোকন-যেখানে বুড়িগঙ্গার দুই তীর ঘিরে পুরনো ও নতুন ঢাকার আধুনিকতা। শনিবার ছিল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের তৃতীয় রজনী। এদিনের পরিবেশনার সূচনা হয় সরোদের সুরে। বেজেছে বাঁশরিয়ার বাঁশির সুর, শোনা গেছে কণ্ঠশিল্পীর খেয়াল, তবলার বোল এবং ধ্রুপদ ও খেয়ালের বিচিত্র পরিবেশনা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ও স্কয়ার নিবেদিত এ উৎসবের সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক। আর্মি স্টেডিয়ামে চলমান উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। তৃতীয় দিনের আয়োজনে প্রথমেই সরোদের বাদন নিয়ে মঞ্চে আসে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের ৭ নবীন শিক্ষার্থী শিল্পী। পরিবেশনায় অংশ নেন কামাল জহির শামীম, খন্দকার শামছুজোহা, ইলিয়াস খান, ইলহাম ফুলযুরী খান, ইশরা ফুলযুরী খান, শরীফ মুহাম্মাদ আরিফিন রনি ও আল জোনায়েদ দিদার। সম্মেলক এ পরিবেশনায় উপস্থাপিত হয় রাগ কাফি। সরোদের বাদন শেষে কর্ণাটকী ঘরানার বাঁশির সুর নিয়ে মঞ্চে আসেন শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন। বিশ্বের আলোচিত বিভিন্ন সঙ্গীত উৎসবে অংশ নেয়া এ শিল্পীর বাঁশির সুরে উঠে আসে রাগ পূরবী কল্যাণী। নিমগ্ন চিত্তের পরিবেশনাটি তন্ময় করে রাখে সুররসিকদের। এই বাঁশরিয়ার সঙ্গে মৃদঙ্গমে সঙ্গত করেন পারুপল্লী ফাল্গুন ও তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার। শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন কর্ণাটকী রীতির বিশিষ্ট বংশীবাদক। বাবা সুব্রহ্মণ্যনের কাছে হাতেখড়ি। এছাড়া তিনি আর কে শ্রীকান্তন, পালঘাট কে ভি নারায়ণস্বামী ও প-িত যশরাজের কাছে তালিম নিয়েছেন। ভারত ছাড়াও বিভিন্ন দেশে জন ম্যাক্লফ্লিন, পাকো দ্য লুচ্যা, জাকির হোসেন, সুলতান খান, বিশ্বমোহন ভট্, অজয় চক্রবর্তীসহ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বহু স্বনামধন্য শিল্পীর সঙ্গে বাঁশি বাজিয়েছেন। সেই বাঁশির সুর এবার শুনতে পেল ঢাকার শ্রোতারা। বাঁশির বাদন থামতেই ভেসে আসে শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করে খেয়ালের সুর। মঞ্চে আসেন ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী ড. প্রভা আত্রে। শুরুতেই কণ্ঠে তুলে নেন রাগ শ্যামকল্যাণ। ধীর লয় থেকে চড়া লয়ে পৌঁছে শ্রোতার অন্তরে ছড়াতে থাকেন সুরের স্রোতধারা। পরের পরিবেশনায় উপস্থাপন করেন নিজ সৃষ্ট রাগ মধুরোকোষ। উৎসব উপভোগকারীদের হৃদয়তন্ত্রীতে বুনে দেন মুগ্ধতার বীজ। সেই মুগ্ধতার রেশ ধরেই রাগ কানাডায় পরিবেশন করেন দাদরানায়োকি। রাগ ভৈরবীতে ভজনের মাধ্যমে শেষ করেন পরিবেশনা। কিরানা ঘরনার অগ্রজ এ শিল্পী খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা, গজল ও নাট্যসঙ্গীতে সমান পারঙ্গম। তাঁর পরিবেশনায় তবলায় সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার। এরপর মঞ্চে আসেন ফরুখাবাদ ঘরানার অন্যতম তবলিয়া প-িত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন তাল আশ্রয়ী পরিবেশনাটিতে তাঁর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়। উভয় তবলিয়ার সওয়াল জবাবেও আনন্দ ছড়ায় শ্রোতাদের অন্তরে। এরপর ধ্রুপদ পরিবেশন করেন প-িত উদয় ভাওয়ালকর। কুমার গান্ধর্ব সম্মাননাপ্রাপ্ত এ শিল্পী শাস্ত্রীয়সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। তার ধ্রুপদে মুগ্ধ হন শ্রোতারা। এ পরিবেশনায় পাখোয়াজে সঙ্গত করেন প্রতাপ আওয়াদ। সেতারে মিষ্টি সুর ছড়িয়েছেন প-িত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ চেয়ার অধ্যাপক পদে আসীন। তাঁর সেতারের সুর মূর্র্ছনায় তবলার বোলে ভিন্নমাত্রা যোগ করেন পরিমল চক্রবর্তী। ভোররাতে মঞ্চে আসেন উৎসবের তৃতীয় রাতের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খান। ভারতের অন্যতম এ খেয়ালিয়া রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা এনায়েত হোসেন খাঁর প্রপৌত্র। বিলম্বিত আলাপের আবেগময়তা, বিস্তারের গভীরতা ও তানকারীর ব্যতিক্রমী পরিবেশনার স্বাদ মেলে তাঁর পরিবেশনায়। এই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তৃতীয় রাতের আয়োজন শেষ হয়। বিচিত্র বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী ॥ শুদ্ধ সঙ্গীতের সুরসুধা আস্বাদনের পাশাপাশি এবারের উৎসবের বৈচিত্র্য ছড়িয়েছে নানা বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে রয়েছে উপমহাদেশের নানা ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। তার কোনটি বহুল পরিচিত, কোনটি আবার চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাদ্যযন্ত্রের পাশে রয়েছে এর পরিচিতিও। প্রদর্শনীতে রয়েছে পাখোয়াজ, সরোদ, টিকিয়া, এ্যাকর্ডিয়ান, সুনাদ, নাকাড়া, হারমোনিয়াম, ইন্ডিয়ান ব্যাঞ্জো, সারেঙ্গী, এস্রাজ, যুগী সারেঙ্গী, কর্ণেট, ক্ল্যারিনেট, বিউগল, ট্রাম্পেট, সানাই, মেঁকুড়, প্রেমজুড়ি, তানপুরা, মাদল, স্বরাজ, গোপীযন্ত্র, সারিন্দা, আনন্দনহরিসহ আরও অনেক বাদ্যযন্ত্র। আজকের পরিবেশনা ॥ আজ রবিবার উৎসবের চতুর্থ দিন। আয়োজনের শুরুতেই কত্থক নৃত্য পরিবেশন করবে মুনমুন আহমেদ ও তার দল রেওয়াজ। এরপর এক তবলায় বোল তুলবেন নীলেশ রণদেব। খেয়াল পরিবেশন করবেন কিরানা ঘরানার শিল্পী জয়তীর্থ মেউন্ডি। তবলায় যুগলবন্দী পরিবেশন করবেন প-িত যোগেশ শামসি ও প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। যুগলবন্দী কর্ণাটকী সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী বেহালাবাদক চুটি রঞ্জনি ও গায়ত্রী বালসুব্রহ্মণ্যন ভগ্নিদ্বয়। প-িত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার পরিবেশন করবেন সরোদ। এ দিনের অনুষ্ঠান শেষ হবে প-িত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
×