সমুদ্র হক ॥ ধনী-গরিব নির্বিশেষে আলুর ব্যবহার এখন সর্বজনীন। চাহিদা বেড়েছে। দেশের আলু বিদেশেও সুনাম কুড়িয়েছে। বেড়েছে রফতানি। কৃষক এখন জানে কিভাবে টিস্যু কালচার করে কম জমিতে অধিক আলু উৎপাদন করা যায়। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন সপ্তম স্থানে। এ তথ্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত প্রায় তিন যুগে আলুর উৎপাদন অন্তত দশগুণ বেড়েছে। ১৯৮০ সালে উৎপাদিত হয় ৯ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫ লাখ টনের বেশি। এ বছর আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক কোটি টনেরও বেশি। ইতোমধ্যে আলু উৎপাদন প্রধান অঞ্চলগুলোতে আগাম জাতের আলু চাষ হয়েছে। শীঘ্রই উৎপাদনে যাবে। রবি ফসলের আলু উৎপাদনের মৌসুমও শুরু হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষক আলু আবাদে কোমর বেঁধে নেমেছে।
একটা সময় আলু ছিল গ্রামের মানুষের খাবার। বর্তমানে কি গ্রাম কি শহর নগর মহানগর আলু আভিজাত্যের খাদ্য তালিকার ওপরের দিকে উঠেছে। ফাস্টফুডে আলু না হলেই নয়। দেশের আলু ফ্রান্সে গিয়ে ফ্রাই তৈরির পর বাংলাদেশে রেসিপি হয়ে ফিরে চায়নিজ রেস্তরাঁয় ঢুকে দেশী পরিচিতি হারিয়ে হয়েছে ফ্রেন্স ফ্রাই। আলু দিয়ে তৈরি হচ্ছে চটপটি, ফুচকা, আলুর চপ, পুরি, লুচি, পরোটা বরফিসহ নানান স্বাদের খাবার। পটেটো চিপসের জনপ্রিয়তা এখন গগনচুম্বী। আলু দিয়ে খাবারের তালিকা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে চাহিদাও বেড়েছে। ষাটের দশকে হল্যান্ডের আলু বাংলাদেশে আমদানি হয়ে আসে। বর্তমানে বাংলাদেশের আলুর চাহিদা বেড়েছে বিদেশে। রফতানি হচ্ছে ভিয়েতনাম, রাশিয়া, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ২৮ দেশে। সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে আলু রফতানি অন্তত দশগুণ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আলু রফতানি হয় সাড়ে ৯ হাজার টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫ হাজার টন।
মাঠপর্যায়ের কৃষকের কথা, গত বছরগুলোতে আলুর ভাল দাম পাওয়া গেছে। আলু রফতানি হওয়ায় এ দাম বেড়েছে। উত্তরাঞ্চলের আলু উৎপাদন প্রধান এলাকা বগুড়া ও জয়পুরহাটে আবাদ বেড়েছে। আলু মৌসুমে বগুড়ার শিবগঞ্জের কিচক এলাকার বড়হাট ছাড়িয়ে বগুড়া-জয়পুরহাট আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই ধারে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে আলু বেচাকেনা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রফতানিকারক ও মহাজনরা ট্রাকের পর ট্রাক পাঠিয়ে আলু কিনে নিয়ে যায়। বর্তমানে আলু আবাদ শুধু নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রতিটি এলাকায় আলু চাষ ছড়িয়ে পড়েছে।
নানা জাতের আলুর আবাদ হচ্ছে দেশজুড়ে। কৃষির বীজ বিভাগ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত আলুর ৭১ জাতের বীজের ছাড়পত্র মিলে অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্ভাবিত জাত ১৩। বাকি জাত দেশের বিভিন্ন কোম্পানির, যা এসেছে বিদেশ থেকে। বেশিরভাগ জমিতে আবাদ হচ্ছে কার্ডিনাল, এসটারিক্স, ডায়মন্ড, গ্রানুলা, বিনেলা, লেডি রোজেটা, কারেজ, এটলাস, বেলিনি, বেলারুশ, আটলান্টিক বিভালাডি, রেড ফ্যান্টাসি ইত্যাদি। এর সঙ্গে বারি উদ্ভাবিত আলু বারি-৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫৬, ৫৭, ৬২, ৬৩ জাত মাঠে আবাদ পর্যায়ে রয়েছে।
আলু আবাদে মাঠের কৃষক এখন অনেক দক্ষ। তারা আগাম আলু উৎপাদনের পাশাপাশি নতুন জাত সংগ্রহ করে। বীজ সংগ্রহে টিস্যু কালচারের মতো উচ্চপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখেছে। জমিতে আলু আবাদের মধ্যেই ভুট্টা চাষে সফলতা এসেছে। কৃষি বিভাগ সূত্রের খবর- দেশে আলু বীজের চাহিদা অন্তত ৭ লাখ টন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বেসরকারী সংস্থা ও কৃষকের ঘরে যে বীজ আছে তা দিয়ে এবারের চাহিদা মিটবে, এমনটি আশা কৃষি অধিদফতরের। বিএডিসি জানিয়েছে, সরকার আলু চাষে গুরুত্ব দিয়েছে। বীজ সার উপকরণ সময়মতো দেশের প্রতিটি এলাকায় পৌঁছানো হয়েছে। গুণগতমানের বীজ সংরক্ষণে বিএডিসির আওতায় রয়েছে ২৫টি হিমাগার। খাবার আলু সংরক্ষণে দেশজুড়ে বেসরকারী পর্যায়ে রয়েছে চার শতাধিক হিমাগার। আলুর রফতানিকারকরা তাদের বিশেষায়িত হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করছে।
বগুড়া অঞ্চলে আলুর আগাম আবাদ প্রায় শেষ। কয়েক দিনের মধ্যে তা বাজারে নামবে। মৌসুমের আলু আবাদে কৃষকের একদ- ফুরসত নেই। বগুড়ার সোনাতলা এলাকার গৃহস্থ তোজাম্মেল বললেন, এবারের আবহাওয়া আলু আবাদের অনুকূলে। গতবারও ভাল ছিল। এবার তিনি ৬ বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করবেন। গতবার করেছিলেন আড়াই বিঘায়। উফশী জাতের আলুর আবাদে লাভ বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কথা- চলতি মৌসুমে দেশজুড়ে আলুর আবাদ বেড়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে।