ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিনা বিচারে বন্দীদের তালিকা করছে কারা কর্তৃপক্ষ

চান মিয়াদের মতো সাড়ে ৪ শতাধিক বছরের পর বছর জেলে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

চান মিয়াদের মতো সাড়ে ৪ শতাধিক বছরের পর বছর জেলে

বিকাশ দত্ত ॥ বিনা বিচারে ১৬ থেকে ১৮ বছর ধরে শুধু চাঁনমিয়া, মকবুল, সেন্টু, বিল্লাল হোসেনই আটক নয়। দেশের ৬৮টি কারাগারে এমন ৫ থেকে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক বন্দী বিচারাধীন অবস্থায় আটক রয়েছেন। সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি কারাগারগুলোতে বিনা বিচারে আটকদের তালিকা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। সেই মোতাবেক কারাগার কর্র্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরি করছে। শীঘ্রই পূর্ণাঙ্গ তালিকা সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটিতে পাঠানো হবে। অপরাধের অভিযোগে আটক হলেও এখনও তাদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে আটক বন্দীদের তালিকা চেয়ে ১৬ নবেম্বর দেশের সকল কারাগারে চিঠি পাঠিয়েছে সুপ্রীমকোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটি। পাঁচ ও দশ বছরের অধিক সময় ধরে যারা আটক রয়েছেন তাদের বিষয়ে দুটি তালিকা প্রস্তুত করে কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি এমন আটক চার বন্দীর নাম আদালতের নজরে আনা হলে তাদের ৪ ডিসেম্বর আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি একজনের বন্দী থাকার বিষয়টি আদালতের নজরে আনার পর তাকে জামিন দেয়া হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এই আদেশ প্রদান করেছে। অন্যদিকে দেশের আইন বিশেষজ্ঞগণ বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেছেন, এটি একটি ভাল পদক্ষেপ। বিনা বিচারে আটক রাখা কোনভাবেই আইনের শাসন সমর্থন করে না। তবে এও দেখতে হবে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে অপরাধীরা বেরিয়ে না যায়। আদালত একটা উদ্যোগ নিয়েছে। আদালত যা করছে তা সঠিক। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিনাবিচারে আটক অপরাধীরা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে বন্দী আছে। তাদের বিচার শুরুই হয়নি। বিষয়টি আদালতের নজরে আনার পর ঐ আসামিদের হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা আদালতের সময়োপযোগী উদ্যোগ। এতে করে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এগুলো অমানবিক কাজ। এগুলো কোনভাবেই আইনের শাসন সমর্থন করে না। আইনের শাসন হচ্ছে কেউ অপরাধ করলে, সেই অপরাধের বিচার করা। বিচারই শুরু হলো না, তারপরও তাকে কারাগারে আটক থাকতে হলো ১৫ থেকে ১৮ বছর। আদালত সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য আদেশ প্রদান করেছে। এর আগে ২০ নবেম্বর বিনা বিচারে দেড় যুগ ধরে কারাগারে থাকা আরও চারজনের সন্ধান মিলেছে। তাদের আগামী ৪ ডিসেম্বর হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। জামিনের অপেক্ষায় প্রায় দেড় যুগ ধরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ওই চারজন হচ্ছেন- চাঁন মিয়া, মকবুল, সেন্টু ও বিল্লাল। বিষয়টি নজরে আনার পর এ আদেশ দেয় আদালত। একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে ওই চারজনকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনেন সুপ্রীমকোর্র্ট লিগ্যাল এইডের আইনজীবী কুমার দেবুল দে ও আইনুন নাহার সিদ্দিকা। এরপর তাদের হাজির করার নির্দেশের পাশাপাশি রুলও জারি করেছেন হাইকোর্ট। রুলে বিনা বিচারে দেড় যুগ আটক চার ব্যক্তিকে কেন জামিন দেয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মানবাধিকার কমিটি চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না জনকণ্ঠকে বলেছেন, আদালত যে কাজটি করেছে তা খুবই ভাল পদক্ষেপ। বিনা বিচারে কাউকে আটক রাখার অধিকার নেই। তাদের অপরাধটা দেখতে হবে। উচ্চ আদালতের নজরে আনা হয়েছে, আদালতই এটা দেখবে। এটা আদালতের সম্পূর্ণ এখতিয়ার। কোন উড়ো খবর দিয়ে কিছু হবে না। ফিজিক্যালি অপরাধীদের আদালতে হাজির করতে হবে। এর পর আদালতের সিদ্ধান্ত। তিনি আরো বলেন, সজাগ থাকতে হবে যাতে এই সুযোগে কোন দুষ্কৃতকারী বেরিয়ে না যায়। আদালত সূত্রে জানা গেছে, যে চার জনের সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একজন ১৮ বছর ধরে কারাগারে আছেন। একজন ১৭ বছর ধরে, আর দুজন আছেন ১৬ বছর ধরে। এর আগে ১৫ নবেম্বর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন ১৭ বছর বিনা বিচারে কারাগারে থাকা ঢাকার সূত্রাপুরের ৫৯, গোয়ালঘাট লেন এলাকার মোঃ শিপন মিয়া। একইভাবে তার বিষয়টি গত ৩০ অক্টোবর নজরে আনা হলে শিপনকে ৮ নবেম্বর হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। ঐ দিন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও জেবিএম হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ দীর্ঘ ২২ বছর আগের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ১৭ বছর ধরে বিনা বিচারে কারাগারে থাকা মোঃ শিপনকে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন প্রদান করেন। সেদিন আদালত তার আদেশে বলেছে, ‘সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং আদালত ব্যর্থ হয়েছে। এটা আমাদের সকলের জন্য লজ্জাকর। এই দায় রাষ্ট্রের এবং বিচারকের।’ সুপ্রীমকোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটি গত ১৬ নবেম্বর বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক বন্দীদের তালিকা চেয়ে দেশের সকল কারাগারে চিঠি পাঠিয়েছে। পাঁচ ও দশ বছরের অধিক সময় ধরে যারা আটক রয়েছেন তাদের বিষয়ে দুটি তালিকা প্রস্তুত করে কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। কারাগারগুলোতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র গরিব ও অসহায় মানুষদের সুপ্রীমকোর্টে বিনা পয়সায় মামলা পরিচালনার ভার বহন করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে দেশের কয়েকটি কারাগারে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধে বিনা বিচারে দীর্ঘসময় ধরে আটক থাকার সংবাদ সুপ্রীমকোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটির দৃষ্টিগোচর হয়েছে। নিম্ন আদালতে বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়া এসব মামলা সাক্ষ্যগ্রহণসহ নানাবিধ কারণে দীর্ঘ সময় ধরে অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে কার্যত সাজা হওয়ার পূর্বেই আটক বন্দী দীর্ঘদিন ধরে কারাভোগ করছেন। সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির কর্মকর্তা রিপন পৌল জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা তালিকা পাঠিয়েছি ১৬ নবেম্বর। এটি প্রসেস করতে সময় প্রয়োজন। আশা করছি আগামী সপ্তাহ থেকেই তালিকা পাওয়া যাবে। বিনা বিচারে কারাগারে আটক নতুন চারজনের একজন চাঁন মিয়া। গত আঠারো বছর ধরে কারাগারে বন্দী তিনি। ঢাকার শ্যামপুর থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কাশিমপুর কারাগারে ১৯৯৯ সাল থেকে বিনা বিচারে বন্দী তিনি। এ দেড় যুগে চাঁন মিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া হত্যা মামলার কোন অগ্রগতিই হয়নি। মামলাটি বর্তমান বিচারাধীন ঢাকার পরিবেশ আদালতে। একই ঘটনা মাদারীপুরের মকবুল হোসেনেরও। মকবুল রাজধানীর উত্তরা থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০০০ সালে। এরপর থেকে দীর্ঘ ১৭ বছর মামলাটি আর আলোর মুখ দেখেনি। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মকবুলের পক্ষে আইনী লড়াই করারও কেউ ছিলেন না। মতিঝিলের এজিবি কলোনির সেন্টু কামাল গ্রেফতার হন ২০০১ সালে। সর্বশেষ গত মাসেও তাকে হাজির করা হয়েছিল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এ। কিন্তু দীর্ঘ ১৬ বছরে ৫৯ কার্যদিবস আদালতে হাজির করা হলেও মামলা শেষ হয়নি। মামলা শেষ হয়নি কুমিল্লার বিল্লার হোসেনেরও। তেজগাঁও থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় বিল্লাল হোসেন কাশিমপুর কারাগারে বন্দী রয়েছেন ২০০২ সাল থেকে। তার মামলাটিও বিচারাধীন আছে ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন মেহেদী জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিনা বিচারে আটক আছে এমন অপরাধীদের বিষয়টি আদালতের নজরে আনার পর আদালত একটা উদ্যোগ নিয়েছে। আদালত যা করছে তা সঠিক। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। তিনি আরও বলেন, এটি প্রসিকিউশনের ব্যর্থতা। রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনদের দায়িত্ব এটা আদালতের নজরে আনা । কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। এটা লজ্জার ব্যাপার।
×