ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কমে এসেছে

মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ছে, সুচিও প্রশ্নবিদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ছে, সুচিও প্রশ্নবিদ্ধ

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তপথে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কমে এসেছে। বাংলাদেশের সীমান্তে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ও নিরাপত্তা বাহিনী তৎপর রয়েছে স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধে। তবে এর মধ্যেই অন্তত পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য রয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সে দেশের বাহিনীর নির্যাতনও কমে এসেছে। কিন্তু আগের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি কল্পনায় শিউরে উঠছে রোহিঙ্গারা। তাদের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টায় রয়েছে। এদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর অব্যাহত নির্যাতন ও দমন-পীড়নের প্রেক্ষিতে সে দেশের সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি। ইান্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বইছে বিক্ষোভ ও নিন্দার ঝড়। মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের দাবিও জোরালো হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করে রাখাইন প্রদেশে নির্যাতন বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়েছে। বার্তা সংস্থা এপি জানায়, মিয়ানমার পুলিশ ইয়াঙ্গুনে বোমা হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন এক মুসলিমকে গ্রেফতার করেছে। তার সঙ্গে রাখাইন প্রদেশে তৎপর রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি পুলিশের। অপরদিকে, জাকার্তায় মিয়ানমার দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনাকারী এক জঙ্গীকে বোমা ও বিস্ফোরকসহ গ্রেফতার করেছে সে দেশের পুলিশ। সব মিলিয়ে নানামুখী চাপে পড়েছে মিয়ানমার সরকার। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ধাতুক শেরি আনিফা আমান শীঘ্রই মিয়ানমার নেত্রী সুচির সঙ্গে সাক্ষাত করে রাখাইন পরিস্থিতি তুলে ধরবেন- এমনই খবর বেরিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। মিয়ানমার পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক এলাকায় বোমা হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা বোমা প্রস্তুত ও হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। তবে এরা রাখাইন প্রদেশে তৎপর রোহিঙ্গা গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তি মিলেছে, এমনই দাবি পুলিশের। শুক্রবার রাতে কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তবে এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ কিছু বিস্ফোরকদ্রব্য, পানির বোতল ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে থাকা মিয়ানমার দূতাবাসগুলো টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া পুলিশ জাকার্তায় বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ আটক করেছে এক জঙ্গীকে। একটি গ্রুপ জাকার্তায় অবস্থিত মিয়ানমার দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনা করছিল। পুলিশ তার কাছ থেকে কিছু জিহাদী পুস্তক, একটি কালো পতাকা, কয়েক রাউন্ড গুলি এবং কিছু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। আগামী মাসের মধ্যে হামলার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গীদের। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে পুলিশ তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে, মিয়ানমারে সংবাদ-মাধ্যমের ওপরও জারি রয়েছে কড়া সেন্সরশিপ। নির্যাতিত রাখাইন রাজ্যে মিডিয়াসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্য প্রকাশের ওপরও আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি। মিয়ানমার টাইমসে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের জন্য এক ব্রিটিশ রিপোর্টারকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ফিওনা ম্যাকগ্রেগর নামের ওই সাংবাদিক গত ২৭ অক্টোবর ডজনখানেক রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণের প্রতিবেদন করেছিলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, সেনা সদস্যরাই এ ধর্ষণ করেছে। সংবাদটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া যায়নি এবং সে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে বলে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে অভিযোগ আনা হয়। সরকারের এ পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে আরএসএফ (রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডারস)। টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তপথে গত দুদিন ধরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা কমে এসেছে। মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা এলাকাসমূহের বৌদ্ধবিহার-বড়ুয়াপল্লীতে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা বস্তি ও শরণার্থী ক্যাম্পে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের উত্তর মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আতঙ্ক কাটছে না। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা রাখাইন প্রদেশ ছাড়ার লক্ষ্যে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন সীমান্তে ভিড় করে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। তাদের গন্তব্যস্থল বাংলাদেশ। কিচু কিছু রোহিঙ্গা সে দেশের সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর দমন-পীড়ন ও নির্যাতনে কোণঠাসা হয়ে নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশ সীমান্তে পালিয়ে আসা মংডুর উত্তরের কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ওপারে অনুপ্রবেশের সুযোগ খুঁজছে। প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় থাকা এবং এ দেশে অবৈধভাবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ন্যায় একটু আশ্রয় বা মাথাগোঁজার ঠাঁই খুঁজছে। তারা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে জল ও স্থলপথে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। খোঁজখবর নিচ্ছে বিজিবি-কোস্টগার্ডের গতিবিধির ওপর। এদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার নারী, স্বামীহারা স্ত্রী, কেউবা পুত্র, পিতৃ ও স্বজনহারা। আবার অনেকের স্বামী আগে থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোজগারের জন্য পাড়ি দিয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি কোনভাবেই যেন অবৈধভাবে রোহিঙ্গারা দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য কড়াকড়ি আরোপ করায় এরা ওপারে অপেক্ষা করছে বলে সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ১৯৭৮ সালে বিএনপি সরকারের আমলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এ দেশে পালিয়ে এসেছিল। কিছুসংখ্যক প্রত্যাবাসন হলেও অনেকে থেকে যায় এ দেশে। ১৯৯১-৯২ সালে খালেদা জিয়ার আমলে মিয়ানমার হতে আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তন্মধ্যে ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন শরণার্থীকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে মোট ৩১ হাজার ৭৫৯ জন নিবন্ধিত শরণার্থী অবস্থান করছে। মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা এলাকাসমূহের বিহার-বড়ুয়াপল্লীতে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খবরে আক্রোশমূলক তৎপরতায় এ দেশে যাতে কোন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হয়, সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে কোন কিছু ঘটুক তা কেউ চায় না। বৌদ্ধপল্লীগুলোতে পুলিশী পাহারা বসিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সরকার টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও রামু এলাকায় জনস্বার্থে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে। বেশ কয়েকদিন ধরে টেকনাফের বৌদ্ধবিহারগুলোতে পুলিশী পাহারা রয়েছে। পাশাপাশি রামু-নাইক্ষ্যংছড়িতেও ৫০টির অধিক বিহার ও পল্লীতে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি তৌহিদ কবির জানান, মিয়ানমারে সহিংস ঘটনার কারণে এ দেশে যেন কোন ধরনের সমস্য সৃষ্টি না হয় সেজন্য বৌদ্ধপল্লী ও বিহারগুলোতে পুলিশী টহল জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রেখে এবং আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের প্রচেষ্টা আর সফল হচ্ছে না। রোহিঙ্গা উগ্রপন্থীদের দিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের আশায় দিন গুনছিলেন বিএনপি-জামায়াতসহ একাধিক দলের কতিপয় নেতা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল। ওই সময় কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাহাড়ে পাহাড়ে খোলা হয়েছিল আরএসওর প্রশিক্ষণ সেন্টার। মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলী ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রায় সময় সফর ও রাত কাটাতেন বলে জানা গেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর গুঁড়িয়ে দেয় ওই প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলো।
×