ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জলি রহমান

জামদানি শিল্পে নতুনমাত্রা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

জামদানি শিল্পে নতুনমাত্রা

প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালী নারীদের অতি পরিচিত। মসলিনের উপর নক্সা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি বলতে সাধারণত শাড়িকেই বোঝানো হয়। বর্তমানে তৈরি নানা পোশাকের সমারোহ থাকলেও জামদানি শাড়ির প্রতি বাঙালী নারীর দুর্বলতা এখনও অমলিন। জামদানি দিয়ে নকশি ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, পর্দা প্রভৃতিও তৈরি করা হত। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নক্সীওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এছাড়া, মুঘল নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পাবার পরে ঢাকার ডেমরায় জামদানি পল্লীর তাঁতিদের আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়। তবে মেধা ও পারিশ্রমিকের অভাবের কারণে তাঁতিরা আর এ পেশায় আসতে চাইছেন না। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার অচল তাঁতগুলো প্রাচীন গৌরবগাঁথার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে। কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িরও একই দশা। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে জামদানি পল্লী স্থাপিত হয়েছে। মিরপুর বেনারশী পল্লীতে তৈরি শাড়ি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাসহ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, চায়না, আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রফতানি করা হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও রয়েছে জামদানির চাহিদা। বর্তমান বাজারে জামদানির উচ্চমূল্য ও বিপুল চাহিদার কারণে বাংলাদেশের এই শিল্পে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। আর এই গতিতে নতুন মাত্রা যোগ করল জিআই সনদ। বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেল জামদানি। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বিসিক চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখারের হাতে এ নিবন্ধন সনদ তুলে দেন। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশের যে কয়েকটি পণ্য সুপরিচিত, জামদানি অন্যতম। এটি বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী পণ্য মসলিনের পঞ্চম সংস্করণ। জামদানি জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ায় দেশীয় ঐতিহ্যগত সুরক্ষার পথে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে গেল। তথ্য অনুযায়ী, পর্যায়ক্রমে জামদানির পর দেশের জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’কে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বর্তমানে এটি প্রক্রিয়াধীন। খুব শিগগিরই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ইলিশ মাছও জিআই নিবন্ধন লাভ করবে। ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ বলা হয় মুঘল আমলকে। এ সময় দেশে-বিদেশে মসলিন, জামদানির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং শিল্পেরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। আঠারো শতকে ইংরেজ দলিল থেকে জানা যায় মলমল খাস ও সরকার-ই-আলি নামের মসলিন সংগ্রহ করার জন্য দারোগা-ই-মলমল পদবির উচ্চপর্যায়ের রাজ কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। প্রতিটি তাঁতখানায় একটি দফতর ছিল এবং এখানে দক্ষ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার প্রভৃতি কারিগরদের নিবন্ধন করে রাখা হতো। দারোগার প্রধান কাজ ছিল মসলিন ও জামদানি তৈরির বিভিন্ন পদক্ষেপে লক্ষ্য রাখা। তৎকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রায় এক লাখ টাকা মূল্যমানের মলমল-খাস মোঘল দরবারে রফতানি করা হতো। ১৭৪৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দিল্লীর বাদশাহ, বাংলার নবাব ও জগত শেঠের জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার জামদানি কেনা হয়। এছাড়া ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা প্রায় নয় লাখ টাকার মসলিন কেনে। তবে আঠারো শতাব্দীর শেষের দিকে মসলিন রফতানি অনেকাংশে হ্রাস পায়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে। এদের নিযুক্ত গোমস্তারা নিজেদের স্বার্থে তাঁতিদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। তাঁতিরা কম মূল্যে কাপড় বিক্রি করতে রাজি না হলে তাদের মারধর করা হতো। অবশ্য তাঁতিদের ওপর অত্যাচার ঠেকাতে কোম্পানি আইন প্রণয়ন করেছিল। ১৭৮৭ সালে জেমস ওয়াইজ এর মতে ৫০ লাখ এবং জেমস টেইলরের মতে ৩০ লাখ টাকার মসলিন ইংল্যান্ডে রফতানি করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮০৭ সালে এই পরিমাণ ৮.৫ লাখ টাকায় নেমে আসে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮১৭ সালে রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমেই কেবল ইউরোপে মসলিন পাওয়া যেত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জামদানি ও মসলিনের এক হিসেব থেকে দেখা যায় সাদা জমিনে ফুল করা কাজের ৫০ হাজার টাকার জামদানি দিল্লী, লক্ষ্মৌ নেপাল, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি এলাকার নবাবরা ব্যবহার করতেন। এই শিল্প সঙ্কুচিত এবং পরে বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে কিছু কারণ ছিল, যার মধ্যে প্রধান কারণ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব। এর ফলে বস্ত্রশিল্পে যন্ত্রের আগমন ঘটে এবং কম মূল্যে ছাপার কাপড় উৎপাদন শুরু হয়। এছাড়া দেশী সুতার চেয়ে তখন বিলেতি সুতার দাম কম ছিল। তৎকালীন মোঘল সম্রাট ও তাদের রাজ কর্মচারীরা এ শিল্পের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েন। ফলে ধীরে ধীরে মসলিন ও জামদানি শিল্প কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। সম্প্রতি সরকারী বিভিন্ন উদ্যেগে জামদানি শিল্প পেয়েছে নতুন মাত্রা। ফলে আশা করা যায় জামদানি শিল্পের আবার সুদিন ফিরে আসবে। এবং অর্থনীতিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
×