ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

প্রতিটি রক্তবিন্দু পবিত্র

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

প্রতিটি রক্তবিন্দু পবিত্র

[২ মে, ১৯৬১ সালের ‘মে দিবস’-এর প্যারোডে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ভাষণের অংশবিশেষ] আজকের এই মে দিবসের প্যারেড কতই না আলাদা আগের দিনগুলোর চাইতে! আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে আজ বিপ্লবের ফলাফল যাচাইয়ের। আজ আমরা শোষণের সেই দিনগুলো পেছনে ফেলে এসেছি, যখন শাসন ব্যবস্থা দরিদ্রের জন্য ছিল না, ছিল না শ্রমিক, চাষী অথবা সেসব অবহেলিত মানুষের জন্য- যারা আমাদেরই অংশ। সেসব শোষকরা কিছুই করেনি স্বদেশের নিরন্ন, দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য, যারা এই মাটিরই সন্তান। কী ব্যতিক্রম আজকের এই প্যারেড! এমনকি সফল বিপ্লবের পর প্রথম প্যারেডটি থেকেও। আজ আর শ্রমজীবী মানুষকে কিছু বোবা নির্বাহী বিচার ব্যবস্থার সামনে হাঁটু গেড়ে করুণা ভিক্ষা করতে হয় না। আজ তারা কোন শোষকের ব্যবহারের উপকরণ নয়। রাষ্ট্র এখন কেবল কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থে শ্রমিকের ঘাম কেড়ে নেয় না। শ্রমজীবী মানুষ আজ বিশ্বাস করে এটি সেই রাষ্ট্র যা একটি আদর্শকে সামনে রেখে পরিচালিত হয়। সেই লক্ষ্যটি হলো- শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কল্যাণ। আর এই আদর্শ নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বিপ্লবের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন আর আজকের এই সমাবেশে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন সেই বার্তাই দিচ্ছে আজ। আজ স্বদেশের মানুষ তাদের জীবন ও কর্মের অর্থ খুঁজে পেয়েছে। সবদিক থেকেই আমরা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা আজ পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার ধারণা রাখি সমাজের সেই দুটি শ্রেণী সম্পর্কে, যার একদল ঘাম ঝরাত, উৎপাদন ও সৃষ্টি করত আর একদল পরগাছা কিছু না করেই সেই শ্রমের ফসল ভোগ করত। আজ আর শ্রমিকরা সেসব পরগাছার জন্য শ্রম দিতে বাধ্য নয়। এই সেই মাতৃভূমি আমাদের, যেখানে আমরা রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের স্বাধীনতা। আমরা শিখেছি নিজেদের শ্রমে ভাগ্য গড়তে। এই মাতৃভূমি হবে আমাদের অনাগত প্রজন্মের সবার কল্যাণের জন্য কেবল মুষ্টিমেয়র নয়। এ কেমন নৈতিকতা, কোন কারণে, কোন অধিকারে তারা কালো মানুষকে ঠেলে দেয় নির্দয় শ্রমের যান্ত্রিক চাকার নিচে, যা কেবল ধনীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে? কোন অধিকারে তারা একজন পুয়ের্তোরিকানকে যুদ্ধক্ষেত্রে মরতে পাঠায়, যে যুদ্ধ কেবল সাম্রাজ্যবাদকে সুরক্ষা দেবে? তাদের কাছে মাতৃভূমির স্বার্থ মানে তাদের কায়েমী স্বার্থ। আজ তাদের চরিত্র আমাদের সামনে পরিষ্কার। আজ পরিবর্তনের হাওয়া বলছে এমন এক জাতি নির্মাণের কথা যেখানে সবাই সবার জন্য- সম্পদ, সুযোগ ও আনন্দে সবার সমান অধিকার। আজ আমরা সেসব শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মেহনতি মানুষকে স্মরণ করি, যারা আমাদের বিপ্লবে রক্ত দিয়েছে। আজকের এই উৎসাহ, আশা আর আনন্দ তাদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর অর্জন। তাদের জন্যই আজকের সমাবেশে আশাবাদী, হাস্যোজ্জ্বল মুখের সমাহার। আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি হাসি সেই সব নিহত বীরদের সমাধিতে অর্পিত পুষ্প। হায়! সেসব অনুপ্রবেশকারী সাম্রাজ্যবাদের দালাল, যারা অনুপ্রবেশ করেছিল যুদ্ধ করতে। সেই সব নির্বোধ যারা সাম্রাজ্যবাদ রক্ষায় যুদ্ধ করে, যেন তারা জানে না সাম্রাজ্যবাদ কী জিনিস? দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি আর সেই সব মানুষ যারা জীবনে মাটিতে পা না রেখেও অন্যের উৎপাদনে ভাগ বসায়। আমরা তাদের চরিত্র জানি। তারা কি চায়? নির্বাচনী ছবিযুক্ত পোস্টার? বিপ্লব আজ খুলে দিয়েছে জনগণের জন্য তথাকথিত গণতন্ত্রের মুখোশ। তাদের রাজনৈতিক দল মানে তো এলিট স্বার্থরক্ষার ক্লাব। আমেরিকা আজ শক্তির ভাষায় কথা বলে। যে ভাষায় হিটলার কথা বলতেন। আমরা একটি মার্কিন পরিবার বা নাগরিকের জন্যও তো হুমকি নই; আমরা বিশ্বাস করি বিপ্লব মানে রাষ্ট্রকে প্রতিদিন নাগরিক ইচ্ছার সামনে নির্বাচনের পরীক্ষা দেয়া। প্রতি চার বছরে একবার নির্বাচন নয়। বিপ্লব মানে প্রতিনিয়ত জনমতকে ধারণ করা। আজ এই বিপ্লবের সমর্থনে যে জনসমাগম, কোন পচে যাওয়া রাজনৈতিক মঞ্চ কি তা দেখেছে? আমরা ভাগ্য গড়ছি আমাদের পথে। আমরা সমবায় গড়ে তুলছি, নির্মাণ করছি স্কুল, খামার, গৃহ, হাসপাতাল। আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনছি, উচ্চশিক্ষায় বৃত্তি প্রদান করছি; সর্বোপরি আমরা আমাদের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে রত- যা আমাদের নাগরিকদের দেবে একটি উন্নত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। আজকের এই প্যারেডে আনন্দের শরিক তরুণ-যুবা বা সেসব পরিবার যারা জানে তাদের শিশুরা যেতে পারবে স্কুলে, পাবে বৃত্তি, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার রাষ্ট্রীয় সমর্থন- যে সুবিধাগুলো পূর্বে পেত কেবল ধনিক শ্রেণীর সদস্যরা। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, অধিকার আকৃতির ওপর নির্ভর করে না। একটি রাষ্ট্র অপরটির চেয়ে বড় হতেই পারে, তাতে কিছু যায় আসে না। হতে পারে আমরা আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু অন্য যে কোন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতোই মাথা উঁচু করে নিজের পথ বেছে নেয়ার অধিকার রাখি। আমরা যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সরকার পদ্ধতি নিয়ে নির্দেশনা দেয়ার ইচ্ছা রাখি না, ঠিক তেমনি আমরা কোন পথ বেছে নেব কিংবা আমাদের সরকার পদ্ধতি নিয়ে কেনেডির পরামর্শের প্রয়োজন বোধ করি না। আজ আমার সামনে উপস্থিত উৎসাহে আলোকিত মুখগুলোতে বিগত দিনে ছিল হতাশার ছায়া। এর কারণ হলো এই গতকাল তারা শ্রম দিয়েছে পরের জন্য আর আজ শ্রম দিচ্ছে নিজ এবং আগামী প্রজন্মের ভাগ্য নির্মাণে। মনে রেখো, ব্যর্থ বিপ্লবের চেয়ে করুণ কিছু হতে পারে না। তাই এই জমায়েতের হাসি আমি নিবেদন করছি শহীদের বেদিতে পুষ্প হিসেবে। যে রক্ত এই পবিত্র ভূমিতে ঝরেছে তা দরিদ্র মেহনতি মানুষের রক্ত। কোন ধনী, সাম্রাজ্যবাদের দালালের নয়। এই রক্ত তাদের নয়, যারা কেবল নিজের সম্পদ রক্ষায় লড়েছে। পরের উপার্জনে জীবন নির্বাহ করেছে। ক্ষমতাবান সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মা বিকিয়ে দেয়া শোষকের রক্ত নয়। গতকালের শোষিতের দেয়া রক্ত আজ তাকে দিয়েছে স্বাধীনতা। এই রক্ত সেসব মানুষের যারা বিপ্লবের বেদিতে জীবন উৎসর্গ করতে এসেছিল হৃদয়ে আদর্শ নিয়ে। এ রক্ত শহীদের, যার প্রতিটি বিন্দু পবিত্র। লেখক : সাংবাদিক
×