ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

প্রস্তাবের পেছনে বিএনপির আসল উদ্দেশ্য কী?

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

প্রস্তাবের পেছনে বিএনপির আসল উদ্দেশ্য কী?

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ১৯ নবেম্বর দলের পক্ষ থেকে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ১৩ দফা সংবলিত একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছেন। বাস্তবায়ন অসম্ভব এবং যা হওয়ার নয় এমন কিছু প্রস্তাব জেনেশুনে উত্থাপন করায় মনে হচ্ছে এটার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন কমিশন গঠন নয়, এর পেছনে অন্য কোন সুগভীর রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে। প্রথমে বাছাই কমিটি এবং পরে তাদের দ্বারা নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ প্রদানের যে পদ্ধতির কথা প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে তা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে একেবারে বেমানান। বাছাই কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একই পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাছাই কমিটি ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দিতে হবে। দুটি দিকের যে কোন দিক থেকে হিসাব করলে মোট রাজনৈতিক দলের সংখ্যা প্রায় তিন ডজনের বেশি হবে। প্রস্তাব মতে, প্রায় সাঁইত্রিশটি দলের মধ্যে একটি দলও যদি ভিন্নমত পোষণ করে তাহলে তখন সকলের ঐকমত্য হয়েছে বলে ধরা যাবে না। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা সদস্যের মতামতের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে সকলকে একমত হতে হবে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর থেকে অচল এবং অবাস্তব প্রস্তাব আর হতে পারে না। কথায় আছেÑ আট মণ ঘিও পাওয়া যাবে না, আর রাধাও নাচবে না। উভয়ক্ষেত্রে নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ এবং অবিতর্কিত ব্যক্তিদের কথা বলা হয়েছে। এসব কথা শুনতে খুবই ভাল শোনায়। এর বিরুদ্ধে কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু দিন-দুনিয়ার বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। এসব গুণের অধিকারী ব্যক্তি কে বা কারা তা একে তো আপেক্ষিক ব্যাপার, তারপর এটা নির্ভর করে যিনি বিচার করছেন তার নিজের অবস্থানের ওপর, কোন্ জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন এটাই মুখ্য বিষয়, বিচার্য ব্যক্তি এখানে গৌণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় সাঁইত্রিশ থেকে চল্লিশটি দল কখনই এক জায়গা থেকে সবাইকে দেখবে না। একপক্ষের কাছে যিনি হিরো, অন্যপক্ষের কাছে তিনি জিরো। এটাই গ্রাউন্ড রিয়েলিটি, অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের জন্য এটা শতভাগ প্রযোজ্য। তবে বিশ্বেও এর উদাহরণ কম নয়। চেঙ্গিস খান মঙ্গোলিয়ান ও তুর্কি এথনেসিটি মানুষের কাছে একজন মহাবীর এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তি। কিন্তু বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষের কাছে তিনি একজন কসাই, নির্মম, নির্দয়, হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী ও ডাকাত। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাদেক আলী, ২০০৬ সালের বিচারপতি আজিজ, ১৯৯৩ সালে মাগুরার নির্বাচনের সময়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি ইদ্রিস বিএনপি ও তাদের সমর্থকদের কাছে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, অবিতর্কিত ব্যক্তি হলেও সারাদেশের মানুষের কাছে তারা কি ছিলেন তা আজকে আবার নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। বিএনপি কর্তৃক মনোনীত রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও ইয়াজউদ্দিনের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। অন্যদিকে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নেয়ার যে কাজটি করেছেন তাতে সারাদেশের মানুষের কাছে তিনি চিরদিন স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু বিএনপির কাছে তিনি বিতর্কিত। এতবড় বৈপরিত্য ও বিভাজনের বাস্তবতায় সাঁইত্রিশটিরও অধিক দলের নির্বাচন কমিশন গঠনে একমত হওয়ার প্রস্তাবকে শুধু অস্বাভাবিক বললে কম বলা হবে, এটাকে সরল-সোজা ভাবারও কোন কারণ নেই। এর পেছনে যে ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে তা বোঝা যায় নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবনার দিকে তাকালে। বলা হয়েছে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করাসহ বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে। এটা হলে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণœ হয় এবং নিচে নেমে যায়। দ্বিতীয়ত, তাদের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানোর ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়, যা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। পরপর দুইজন সামরিক শাসক সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে জড়িয়ে দেশের যে ক্ষতি করেছেন তা প্রত্যক্ষ করার পরেও যারা এমন প্রস্তাবনা দেন তাদের উদ্দেশ্যকে কোনভাবে সহজ- সরল ভাবার কারণ থাকতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো- নিজেদের পেশার বাইরে এসে অভিজ্ঞতা ও যথাযথ প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে মাত্র সাতদিনের জন্য বিচারিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালন করার প্রস্তাব একেবারে অবাস্তব, অনাকাক্সিক্ষত এবং হিতে বিপরীত হওয়ার শামিল। নিজেদের পেশা ও প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সদস্যরা কিছু রাজনীতিকের কবলে পড়ে কিরকম হেনস্থা হয় তা তো প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। তবে এটা পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব, তাদের সেটি ফেস করতে হবে। কিন্তু পুলিশের জায়গায় টেনে এনে সেনাবাহিনী ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি করার মধ্যে কোন ভাল উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য। কিন্তু যেহেতু এটা একটি রাজনৈতিক সমস্যা, তাই এর শেকড়ের গলদ ঠিক না করে মাত্র চার-পাঁচজন ব্যক্তির মাধ্যমে সকল পক্ষের প্রত্যাশা পূরণ করা দুরাশা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই রাজনৈতিক শেকড়ের গলদ সর্বাগ্রে ঠিক করতে হবে। একটা মর্যাদাশীল জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের রাজনৈতিক দলের একই সঙ্গে মাঠে অবস্থান সম্পূর্ণ অবাস্তব, অযৌক্তিক, অনৈতিক এবং জাতির জন্য অবমাননাকর। এটা চলতে পারে না, চলতে দেয়া যায় না। এ দু’পক্ষের মধ্যে কোন সমঝোতা বা গিভ এ্যান্ড টেক হতে পারে না, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অপরিহার্য। এ দু’পক্ষের মধ্যে যে সমঝোতা হতে পারে না তার একাধিক উদাহরণ বিগত সময়ে দেখেছি। এর মূল কারণ দুটি। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন বাঙালী সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রসঙ্গে সমঝোতা করার অধিকার কোন রাজনৈতিক দলের নেই। দেশের মানুষ তা মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত, যে কারণে সমঝোতা সম্ভব নয় তা হলো- এক পক্ষের ক্ষমতায় আরোহণে অন্য পক্ষের মনস্তাত্ত্বিকতায় অস্তিত্বের সঙ্কট সৃষ্টি হয় এবং তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই দেখা যায় ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকার রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বোমা-গ্রেনেড মেরে একেবারে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে নিহত হন এবং জীবিতদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন নিপীড়ন ও নির্যাতন। রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে সকল নীতিমালা এমনভাবে প্রণয়নের চেষ্টা করা হয় যাতে বাঙালী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যে ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার মতো সুযোগ আর না থাকে। ২০০৬ সালের পর আরেক মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকার অব্যাহত থাকলে এতদিনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল এবং কোন কণ্ঠস্বর অবশিষ্ট থাকত বলে মনে হয় না। কিন্তু বাঙালী সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটা বিশাল সহজাত শক্তি রয়েছে বলেই সেটি তারা পেরে উঠেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে প্রায় অভিযোগ করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের শেষ করে দিতে চায়। এই অভিযোগের মধ্যে সত্য-মিথ্যা থাকতে পারে। তবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মতো গ্রেনেড আক্রমণ বিএনপির ওপর হয়নি। হুমায়ুন আজাদের মতো কোন বুদ্ধিজীবীকে চাপাতির কোপের নিচে পড়তে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের-বিপক্ষের রাজনীতিকে জিইয়ে রেখে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য নির্বাচনে হেরে যাওয়াকে মেনে নেয়াটা কোন পক্ষের জন্য সহজ হচ্ছে না। যারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মূল তত্ত্বকথা বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না এবং স্বাধীনতার প্রধান অনুঘটক ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী নেতৃবৃন্দকে শুধু অস্বীকার নয়, এর সবকিছুকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চায়, তাদের কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলা যায়? এই প্রশ্নের মীমাংসা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করতে হবে। সেটি না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। দুই সামরিক শাসকের নির্বাচনী প্রহসনের কথা বাদ দিলেও নব্বই দশকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন কমিশন এসেছে তার কোনটাই কি বিতর্কের বাইরে থাকতে পেরেছে? ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সাদেক আলী কমিশন, মাগুরা থেকে পালিয়ে আসা ইদ্রিস আলী কমিশন, আজিজ মার্কা কমিশন এবং বিগত জরুরী আইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের শামছুল হুদা কমিশন, এরা কেউ বিতর্কের বাইরে থাকতে পারেনি। সুনাম নিয়ে বিদায় নিতে পারেনি। ২০০৭ সালে শামছুল হুদা কমিশন তো সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও শামছুল হুদা কমিশন মিলে বাংলাদেশের রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত পেরে না উঠে অবশেষে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। সুতরাং রাজনৈতিক সমস্যার শেকড়ে হাত না দিয়ে পাঁচ ব্যক্তিকে নিয়োগের জন্য যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা যে অবাস্তব সে কথা বিএনপিও ভাল করে জানে। জেনেশুনে এমন একটা অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব দেয়ার পিছনে সম্ভব্য দু’টি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে একটার পর একটা রাজনৈতিক ব্লান্ডারের মাধ্যমে রাজনৈতিক মাঠ থেকে যেভাবে ছিটকে বাইরে পড়েছে সেখান থেকে ফিরে এসে রাজনীতির মাঠে আবার সরব হওয়ার একটা কৌশল ও পন্থা হিসেবে তারা আলোচ্য প্রস্তাবটি দিয়ে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি নিজেদের গায়ে লাগা ময়লা অন্যদের গায়েও লেপটে দেয়ার একটা চেষ্টা আগাগোড়া সব সময়ই করে আসছে। তাদের গায়ে ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতির কলঙ্কের দাগ লেগে আছে। তাই বর্তমান রাষ্ট্রপতি সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ্যাডভোকেট মোঃ আবদুল হামিদকে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে আগামীতে কোন রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্র প্রস্তুতির জন্য বিএনপি এমন প্রস্তাব দিয়ে থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। তবে বর্তমান রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ও ইয়াজউদ্দিনকে একই পাল্লায় মাপার চেষ্টা করলে সেটা বিএনপির জন্য আরেকটি রাজনৈতিক ব্লান্ডার হবে। লেখক: ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×