ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

বুদাপেস্ট পানি সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

বুদাপেস্ট পানি সম্মেলন

২৮ নবেম্বর থেকে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে শুরু হচ্ছে পানি শীর্ষ সম্মেলন। এ সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুদাপেস্ট যাচ্ছেন। হাঙ্গেরির মিনিস্ট্রি অব ফরেন এ্যাফেয়ার্স এ্যান্ড ট্রেড সূত্রে জানা গেছে, সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ২৮ নবেম্বর স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। একই দিন সকাল সাড়ে ১১টায় রয়েছে পানি ও এসডিজি বিষয়ক প্যানেল আলোচনা। দুপুর ২টায় আলোচনা হবে সুপেয় পানি নিশ্চিত করা নিয়ে। বিকেল ৩টায় আলোচনার বিষয়ও সুপেয় পানি নিয়ে। তিনদিনের শীর্ষ সম্মেলনে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন আলাচনায় প্রাধান্য পাবে। পৃথিবীব্যাপী সুপেয় পানির উৎস ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে। কমছে কৃষি কাজে ব্যবহƒত পানির পরিমাণও। হুমকির মুখে পড়ছে প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। সার্বিকভাবে মানবজাতি ক্রমেই এক গভীর সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় সম্প্রতি মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সংক্রান্ত বৈশ্বিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি পানি বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জনে গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে সহায়তা করতে একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য এই তহবিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করার অবকাশ রয়েছে। বিশ্বের ৭০০ কোটি জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বাস এশিয়ায়। কিন্তু ২০৩০ সাল নাগাদ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পানির চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান দাঁড়াবে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মারাকেশ সম্মেলনে কিছু বিষয়ে জরুরী নজর দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রথমত, জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমন্বিতভাবে কৃষিতে সেচ ব্যবস্থার মানোন্নয়ন, জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ক্রমবর্ধমান শিল্পে পানির চাহিদা পূরণ প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ কার্যকরভাবে প্রতিরোধ, সফলভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও বর্জ্য পানি পরিশোধনের জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং হস্তান্তরে বিভিন্ন দেশকে অবশ্যই মেধাস্বত্ব অধিকারের (আইপিআর) সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে এগিয়ে আসতে হবে। তৃতীয়ত, সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে ও দেশীয় উদ্যোগের মানোন্নয়ন ঘটিয়ে পানি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সীমিত ভূগর্ভস্থ সম্পদের পুনর্ব্যবহার, পরিশোধন ও এর সুষ্ঠু ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। চতুর্থত, বিভিন্ন নদ-নদীর পানি সংরক্ষণ ও নাব্য অক্ষুণœ, অন্যান্য আন্তঃদেশীয় নদ-নদীর পানির ন্যায্যহিস্যা নিশ্চিত এবং নদী অববাহিকা ও প্রতিবেশ রক্ষায় নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তিন-চতুর্থাংশের বেশি দেশ গুরুতর পানির প্রাপ্যতা সমস্যা মোকাবেলা করছে। বিশ্বব্যাপী পানি ও স্যানিটেশনের অসহজলভ্যতা দিন দিন বাড়ছে। নদ-নদী ও জলাভূমির বেহাল অবস্থার কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়ণ, দূষণ এবং ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় পানির নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। আন্তঃদেশীয় নদীর পানি বণ্টন জটিল হয়ে উঠলেও বাংলাদেশ ও ভারত গঙ্গা নদীর পানি দীর্ঘমেয়াদে বণ্টনের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আন্তঃদেশীয় নদ-নদীর পানির সুষম বণ্টন এবং নদী অববাহিকা ও পরিবেশের নিরাপত্তায় চুক্তি সম্পাদন এবং যৌথ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে। এখন ‘নেটওয়ার্ক অব এশিয়ান রিভার বেসিন অর্গানাইজেশনের’ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের নেটওয়ার্ক একে অন্যের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিনিময়ে সহায়ক হবে। পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য পানি ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো ও জ্ঞান বিনিময় নেটওয়ার্কের জরুরী প্রয়োজন রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যদি কখনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় তা হতে পারে পানি নিয়ে বিরোধের কারণে। সুপেয় পানি বা কৃষি কাজে ব্যবহƒত পানির অভাবে পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু উদ্বাস্তুর পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। নদী থেকে সেচের মাধ্যমে কৃষি কাজও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দূষণের কারণেও কিছু নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। অনেক নদী মরে বা হারিয়ে গেছে। এসবকিছুরই ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ক্রমাগতভাবে কৃষির ওপর। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও নোনা পানি অনুপ্রবেশের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিও ব্যাহত হচ্ছে। কৃষি ব্যাহত হলে খাদ্যোৎপাদন ব্যাহত হবে এবং জনজীবনে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। সমস্যা প্রবল আকারে মাথার ওপর এসে পড়ার আগে সমাধানের উদ্যোগও বাংলাদেশকে নিতে হবে। বাংলাদেশে নোনা পানি সহিষ্ণু চাষাবাদ উন্নয়নে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা বা অভিযোজন বিষয়ে সীমিত পরিসরে গবেষণা চলছে। নোনা পানির অনুপ্রবেশ বন্ধে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়ার মতো সক্ষমতাও বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেরই নেই। তাদের জন্য বৈশ্বিক গবেষণা ও বৈশ্বিক উদ্যোগ খুবই জরুরী এবং তা করতে হবে সময় থাকতে। আশা করা যায়, বৈশ্বিক পানি সমস্যা নিয়ে এই সম্মেলনে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে। বাংলাদেশেও পানি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং মিঠা পানি সংরক্ষণের আশু উদ্যোগ নিয়ে ভাবতে হবে। অধিকাংশ নদীর গভীরতা এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, খনন না করলে দুয়েক দশকের মধ্যে সেগুলোও শুকিয়ে বা মরে যাবে। নদী ও জলাধার রক্ষা করা না গেলে মিঠা পানি ধরে রাখা যাবে না। নোনাপানির অনুপ্রবেশ ক্রমেই বাড়তে থাকবে। এখনই ভূগর্ভস্থ স্তরে নোনাপানি দেশের প্রায় মধ্যাঞ্চলে চলে এসেছে। তা আরও বিস্তৃত হবে। কৃষি কাজে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে। সুপেয় পানি ও কৃষি কাজে ব্যবহƒত পানির অভাবে জনজীবনও ক্রমশ হুমকির মুখে পড়বে। তাই দ্রুত করণীয় নির্ধারণ করতে হবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সে কাজগুলো সম্পাদন করতে হবে। এক্ষেত্রে নিজস্ব উদ্যোগের পাশাপাশি বৈশ্বিক সহযোগিতা পাওয়ারও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বুদাপেস্ট পানি সম্মেলনে সুযোগ পেলে এসব বিষয় উত্থাপন করা যেতে পারে। মানুষের পানির অধিকার মৌলিক। যতই দিন যাচ্ছে গোটা বিশ্বে পানির জন্য মানুষে মানুষে সংঘাত বাড়ছে, কোথাও কোথাও এখনও বিরোধ চলছে। এ সংঘাতের সমাধান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হচ্ছে ন্যায়সঙ্গত হিস্যা নিশ্চিত এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা। বিশ্বের সব মানুষের সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের অধিকার নিশ্চিত করতে বুদাপেস্ট পানি সম্মেলন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসবে এমন আশা সকলের। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×