ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহান বিপ্লবীর বিদায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

মহান বিপ্লবীর বিদায়

চলে গেলেন মহান বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো, বিশ্বব্যাপী শ্র্রদ্ধাভাজন নেতা, কিউবার গণমানুষের স্বপ্নের পুরুষ। তার স্বদেশ কিউবার স্বপ্ন সফল করার জন্য লড়েছেন, সংগ্রাম করেছেন, সর্বোপরি সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করেছেন। ফলে তার দেশবাসী পেয়েছে এমন একটি পরিবর্তিত কল্যাণকামী রাষ্ট্র যেখানে আছে সব নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। আর বর্তমানে দেশটির শিক্ষিতের হার ৯৯.৭%, গড় আয়ু ৮০ বছর। বাস্তবিকই দেশটি বিশ্বে অনুসরণীয় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাধারণ মানুষের বন্ধু ও ত্রাতা হিসেবে ক্যাস্ট্রোর আবির্ভাব ছিল সুন্দরতম স্বপ্নের মতো। ত্রিশের তোরণে দাঁড়ানো এক তরুণ তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে পরাক্রমশালী আমেরিকার একেবারে নাকের ডগায় ঘটিয়ে ফেলেছিলেন এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। তারপর সেই সাম্রাজ্যের অবিরাম বিরোধিতা আর চোখ রাঙানির ভেতরও টিকিয়ে রেখেছিলেন সেই বিপ্লবের মোহন মন্ত্রকে। এক সময় নদীর পাড় ভাঙ্গার মতো পৃথিবীর চারদিকে এক এক করে শোনা গেল সমাজতান্ত্রিক চরাচরের ভাঙ্গনের শব্দ; কিন্তু তবু ক্যাস্ট্রো তার নিঃসঙ্গ দ্বীপটিতে জ্বালিয়ে রাখলেন সেই পুরনো স্বপ্নের বাতিঘর। ১৯৫৬ সালের কথা। স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে নিজ দেশে ফিরে স্বাধীনচেতা তরুণ ক্যাস্ট্রো ‘২৬ জুলাই মুভমেন্ট’ নামে একটি বিদ্রোহী দল গঠন করেন এবং ধীরে ধীরে দুর্নীতিপরায়ণ, নৈতিকভাবে দুর্বল ও যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে দেন। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে তিনি তার দেশের মানুষের জন্য সমতা ও সমৃদ্ধি বয়ে আনতে সমর্থ হবেন। দুই বছরের মধ্যে তার দল সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করে এবং ক্রমেই গেরিলাযুদ্ধে শক্তিধর হয়ে ওঠে। এতটাই শক্তিমান হয়ে ওঠে যে এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত কিউবার শাসক দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো হয়ে ওঠেন দেশটির অবিসংবাদিত নেতা। এরপরের প্রায় পাঁচটি দশক তিনি গভীর জাতীয়তাবাদী এবং মার্কসবাদী চেতনা নিয়ে দেশটি শাসন করেন, বলা যায় দেশটির সেবা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছে বসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে পরোয়া না করে ফিদেল ক্যাস্ট্রো যুগের পর যুগ যেভাবে নিজের এবং স্বআদর্শের অস্তিত্ব রক্ষা করে গেছেন, সেটি এক অনন্য ইতিহাস। তিনি ৬৩০বার যুক্তরাষ্ট্রের হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তাকে বিষাক্ত ক্যাপসুল, সিগারেট এবং ডাইভিং স্যুটে রাসায়নিক বিষ মিশিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কোন ষড়যন্ত্র ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে দমাতে পারেনি। প্রায় এক দশক আগে অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্রের প্রধান পদ থেকে তিনি অবসর নেন, অহেতুক ক্ষমতা আঁকড়ে রাখেননি। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফিদেল ক্যাস্ট্রো তার দেশে বিশ্বমানের স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। কিউবায় নারী ও শিশু মৃত্যুর হার যেকোন ইউরোপীয় দেশের তুলনায় ভাল। কিউবাতে প্রতি ১৭০ লোকের জন্য ১ জন ডাক্তার রয়েছে, যা অনেক উন্নত দেশের তুলনায়ও অনেক ভাল। কিছুকাল হলো যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ কিউবার স্বাস্থ্য পরিচর্যা পদ্ধতি অনুসরণ শুরু করেছে। বিপ্লবীর মৃত্যু হয়, বিপ্লবের মৃত্যু নেই- এমন কথা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জাগতিক নিয়মে ক্যাস্ট্রোকে বিদায় নিতে হয়েছে, এটা সত্যি। কিন্তু তার এবং তার আদর্শ চিরঞ্জীব। আমাদের এই বিচিত্র গ্রহটি যখন নিরাময়-অযোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে, তখন বঞ্চিত, লাঞ্ছিত দলিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন, সংগ্রাম ও আকাক্সক্ষায় ফিদেল ক্যাস্ট্রোই হতে পারেন চিরসবুজ এক মহাপ্রেরণা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বেলায়ও তিনি ছিলেন এক পরম সুহৃদ। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ কথাটা এখন প্রায় কিংবদন্তি। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের পরম মিত্র এই মহান বিপ্লবীর স্মৃতির প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
×