ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবার আসিব ফিরে... নবান্নের দেশে

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

আবার আসিব ফিরে... নবান্নের দেশে

আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, হয়ত মানুষ নয় হয়ত শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের এই মিনতি ভরা প্রত্যাশা স্মরণ করিয়ে দেয় অপরূপ গ্রাম বাংলার নবান্ন উৎসবের আবেদন। নবান্ন উৎসব আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতি। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ষোলোয়ানা বাঙালিয়ানা। অগ্রহায়ণ মাস এলেই বাঙালীর ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। নতুন ধানকাটা আর ঘটা করে সেই ধানের প্রথম ভাত বা অন্ন খাওয়াকে নবান্ন উৎসব বলে। কিষাণপাড়ায় মহা ধূমধামে এ নবান্ন উৎসব পালিত হয়। কোন কোন বাড়ির গেরস্থ পাড়া-প্রতিবেশী, ইষ্টিকুটুম, আত্মীয়স্বজন নিমন্ত্রণ করে নতুন ধানের ঢেঁকি ছাঁটা চালের অন্ন রান্না করে উৎসব পালন করে থাকে। এ উৎসব বহু বছর ধরে বাঙালীর ঘরে ঘরে পালিত হয়ে আসছে। এ জন্য নবান্ন প্রাণের উৎসবের রূপ নিয়ে পরস্পরের হৃদয়ের বন্ধন আরও নিবিড় করে তোলে। তবে সেকাল-একালের নবান্নের মধ্যে ব্যবধানও রয়েছে উৎসব কেন্দ্রিক। হেমন্তে শীতের আগমনী বারতায় ¯িœগ্ধ ভোরে টুপটাপ শিশিরের শব্দ জানান দেয় আজ পহেলা অগ্রহায়ণ, নবান্ন উৎসবের দিন। দিনটি এলেই প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে-দিগন্ত ছুঁয়ে যায় হলুদ-সবুজ রঙে। এমন অপরূপ দৃশ্য বাংলা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। তাই তো কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠেÑকিষাণির ঠোঁটের কোণায় ঢেউ খেলে যায় সুখের ঝিলিক। কৃষকের ঘর ভরে যায় নতুন ধানে। কৃষকের বুক ভরা এ আনন্দ যেন অনন্ত কালের। নিমেষে ভুলে যায় সারা বছরের শ্রম আর কষ্টের কথা। বাঙালীর জীবিকার প্রধান ফসল ধান। গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার শুরুতে ভাটি অঞ্চলে বোনা আমন ধানের চাষ করা হয়। হেমন্তে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের ফসলী মৌসুমে সোনালী পাকা ধানে মাঠ ভরে ওঠে। বেড়ে যায় কৃষকের কর্ম-ব্যস্ততা, শুরু হয় নতুন ধানকাটা আর মাড়াই মহোৎসব। এ সময় কিষাণপাড়ায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এ কারণে অনাদিকাল ধরে বাঙালীর জীবনে পহেলা অগ্রহায়ণকে বলা হয় শুভক্ষণ। ফসলকাটা, মাড়াই হেমন্তের এ দিনটি প্রতি বছর ফিরে আসে নবান্নের উৎসব হয়ে। নবান্ন না হলে হেমন্ত ঋতু পূর্ণতা পায় না। এই নবান্নে প্রথম ধানের নতুন চালের তৈরি হরেক রকম পিঠা, পায়েস, ক্ষীর আর লক্ষ্মীদিঘা চালের সুস্বাদু ভাতের ম ম গন্ধে কৃষকের বাড়ি-ঘর ভরে ওঠে। আঙিনায় নতুন ধানের পালা গোছানোর কাজে কিষাণিরা ব্যস্ত থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। ক্লান্তিহীন শ্রমে সোনালী ধানে ভরে ওঠে কৃষকের ভাড়ার। সোনালী ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম বিশেষ অংশ নবান্নকে কবি জীবনানন্দ দাশ দেখেছেন এইভাবেÑচারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/ পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে। যুগে যুগে নবান্নকে ঘিরে বাংলার বিচিত্র রূপের বর্ণনা দিয়েছেন কবি-সাহিত্যিকরা। কুয়াশা ভরা চারদিক শিশির ভেজা মেঠোপথ বেয়ে কৃষকের গোলায় উঠছে পাকা ধান। চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি। কৃষকের মাঠে এখন সোনা ধানের ছড়াছড়ি। সারা দেশে এখন আমন ধান কাটার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখতির হয় বাড়ির আঙিনা। নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। কিষাণ-কিষাণিরা নবান্নের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় পাড়া-পড়শীদের সঙ্গে। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×