ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সার্বজনীন উৎসব নবান্ন

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

সার্বজনীন উৎসব নবান্ন

নবান্ন ফসলভিত্তিক লোকউৎসব। নানা লোকাচার জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। এর আবেদন চিরকালীন। দেশে দেশে বিভিন্ন রূপে নবান্ন পালিত হলেও এটি বাংলা ও বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতি, যা হাজার বছরের গৌরবে গৌরবান্বিত। নবান্ন উৎসবে মুগ্ধ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাইতো লিখেছেন- ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে/হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। মানুষ যখন থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলেছে, তখন থেকে জীবন ব্যবস্থায় শস্যভিত্তিক একের পর এক নানা উৎসবের সংযোজন ঘটেছে। তেমনি এক উৎসব-নবান্ন। কঠোর পরিশ্রমে ফলানো ফসলকে উৎসবের মাধ্যমে বরণ করে নিতেই এর আয়োজন করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে এর প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের আদিবাসীরাও নতুন ফসল বরণ করে নিতে উৎসবের আয়োজন করে। যেমন সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে নিতে আয়োজন করে ‘সোহরায়’ উৎসব। তারা সাতদিন-সাত রাত গানবাজনা এবং মদপানের মাধ্যমে এ উৎসব পালন করে। উসুই আদিবাসীর মানুষ অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ‘মাইলুকমা’ উৎসব পালন করে। ম্রো জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ‘চামোইনাত’ উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভুরিভোজন করায়। ফসল তোলার পর গারো আদিবাসীরা ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ‘ওয়ানগালা’ উৎসব পালন করে। রাখাইনরাও আয়োজন করে বিভিন্ন উৎসবের। দেশ, কাল, পাত্রভেদে সময়ের বিবর্তনে এসব উৎসবের আঙ্গিক হয়ত পাল্টেছে কিন্তু পাল্টায়নি আবেদন। বিশেষত বাঙালীর কাছে নবান্ন চিরন্তন উৎসব। এর আবেদন চিরকালীন। বাংলাদেশের গাঁ-গেরামে নবান্নোৎসবে কয়েকটি পর্ব রয়েছে। যা বেশ পবিত্রতার সঙ্গে মানা হয়। যেমন প্রথমেই বাংলাদেশের বাঙালী কৃষক প্রধানত অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে-অগ্রহায়ণকে কৃষিভিত্তিক সমাজে এক সময়ে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হতো। এ সময় কৃষকের ঘরে নতুন আমনের ধান উঠত। সর্বশেষ মোঘল আমলেও অগ্রহায়ণ বছরের প্রথম মাস হিসেবে পরিগণিত হতো। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন, তাই বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ শুভ পবিত্র দিন হিসেবে ধরা হতো। এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ফসল বরণ করে নেয়া হতো। পরবর্তীতে অগ্রহায়ণ ছাড়া পৌষ এবং মাঘ মাসেও নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। তবে তা পালন করা হয় শুভদিন দেখে। পঞ্জিকা দেখে শুধু শুভদিন নয়, এর পাশাপাশি শুভক্ষণ, শুভলগ্ন, শুভতিথি, বারবেলা, কালবেলা এমন অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়ে কৃষক নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে আজও এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে-নবান্নের কয়েকদিন আগ থেকে কৃষক বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। সমস্ত আগাছা-আবর্জনা দূর করে। এক-দু’দিন আগে উঠোনসহ পুরো বাড়ি মাটি বা গোবর দিয়ে লেপা হয়। বাড়ির বধূরা উঠোনে আঁকে মনোরম দৃষ্টিনন্দন আল্পনা। তার আগে স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় আমন্ত্রণ। যে কারণে নবান্নের দিনে গোটা বাড়ি আত্মীয়স্বজনে গম গম করে। বাড়ির প্রধান কর্ত্রীকে নতুন কাপড় পরানো হয়। দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দু কৃষকদের একটি অংশ নবান্নের দিনে সবার আগে স্বর্গীয় পিতৃপুরুষদের নতুন অন্ন দান করে। এজন্য অনেকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করে। এদের বিশ্বাস-পিতৃপুরুষদের নতুন অন্ন দান না করে নবান্ন গ্রহণ করলে তা মহাপাপ। এরা পিতৃপুরুষদের নতুন অন্ন দেয়ার জন্য কাকবলির আয়োজন করে। ‘কাকবলি’ একটি প্রচলিত শব্দ। কাকের মাধ্যমে নতুন অন্ন দান করা হয়, তাই এর নাম কাকবলি। নবান্নের দিনে অতি প্রত্যুষে কলা গাছের খোলে নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে-কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে অনেক ছড়া আছে। যা ছোট ছেলেমেয়েরা নেচেগেয়ে গানের মতো সুর করে আওড়ায়। এমন একটি ছড়া হচ্ছে- ‘কো কো কো, আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন। শুভ নবান্ন খাবা, কাকবলি লবা, পাতি কাউয়া লাঠি খায়, দাড় কাউয়া কলা খায়, কো কো কো। কাকবলি ছাড়াও নবান্নের দিনে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জায়গায় আজও লক্ষ্মীপূজা ও বীরবাঁশ প্রথার প্রচলন রয়েছে। বীরবাঁশের জন্য বাড়ির উঠোনের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আল্পনা আঁকা হয়। গর্তে জ্যান্ত কৈ মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে ধানের ছড়া বাঁধতে হয়। এটাকে বীরবাঁশ বলে। নবান্নের আরেকটি পর্ব হচ্ছে-ঘরে নতুন ধান তোলা। এজন্য কৃষক একগোছা ধানসহ গাছ ক্ষেত থেকে তুলে নিয়ে আসে এবং ওই ধানগাছের গোছা বাড়ির উঠোনের পূর্ব পাশে বাঁশ পূঁতে বেঁধে রাখা হয়। তাতে দেয়া হয় সিঁদুরের তিন কিংবা পাঁচটি ফোঁটা। কলাগাছের খোল পাতলা করে কেটে তার মধ্যে এক-দু’ ছড়া ধান রাখা হয়। সঙ্গে পান-সুপারি, তুলা, কড়িসহ নানা উপকরণ দিয়ে খোল ভাঁজ করা হয় এবং তা উলুধ্বনি দিয়ে ঘরে তোলা হয়। ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের খুঁটির সঙ্গে উপকরণসহ কলাগাছের খোল সারা বছরের জন্য বেঁধে রাখা হয়। ধান ঘরে তোলে বাড়ির বয়স্ক সধবা গৃহিণী। যারা এ পর্বটি পালন করে, তাদের বিশ্বাস-সারা বছর এ বাড়ি অন্ন এবং অর্থকড়িতে ভরপুর থাকবে। নবান্নের দিনে নতুন চালে বিশেষ এক ধরনের মিষ্টান্ন বানানোর প্রথা এখনও দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সর্বত্র চালু রয়েছে। মিষ্টান্ন তৈরির জন্য প্রথমে ঢেঁকিতে নতুন ধানের আতপ চালের গুঁড়া করা হয়। এতে প্রচুর নারকেল ও গুড়-চিনিসহ উপাদেয় বিভিন্ন উপকরণ মেশানো হয়। এ মিষ্টান্নকে অনেক জায়গায় ‘মলিদা’ বলে। নতুন ধানের মুড়ি কিংবা খৈ দিয়ে মলিদা খাওয়া হয়। মলিদা তৈরি হয় মাটির নতুন পাতিলে। মলিদা খাওয়ার আগে পূজা করা হয়। এর পরে রয়েছে দুপুরের ভোজন। নবান্ন উপলক্ষে দুপুরের ভোজন হয় অন্য রকমের। অনেক বাড়িতে ২০ থেকে ৪০ পদের রান্না হয়। মাছ থাকে কয়েক পদের। গ্রামের গৃহস্থ পরিবার সারা বছর পুকুরে বড় মাছ রেখে দেয় নবান্নের জন্য। থাকে কয়েক পদের শাক ও তরকারি। এছাড়া, নতুন ধানের চালে অনেক পদের পিঠে-পায়েস তৈরি হয়। নবান্নের দিনে বাড়িতে আসে নাইওর। নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো মেলা। হরেক রকমের দোকান নিয়ে বসে গ্রামীণ মেলা। যদিও গ্রামীণ মেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না; শহরেও আয়োজন হয়। এ মেলায় পাওয়া যায় পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটির জিনিসপত্র আর বসে বাউল গানের আসর। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে গ্রামগঞ্জে সব শ্রেণীর মানুষের ঢল নামে। নাচ আর গানে মুখরিত হয় মেলাপ্রাঙ্গণ। প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে আত্মহারা হয় বাঙালীমানস। সময়ের বিবর্তনে যদিও নবান্ন মেলা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে এখন এটি দেখাই যায় না। একইভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে নবান্নের রাতের নানা আনন্দঘন আয়োজন। এক সময়ে গ্রামাঞ্চলে নবান্নের রাতে এক শ্রেণীর শৌখিন মানুষ মুখোশ পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষকে আনন্দ দিত। এ প্রথাটিও এখন বিলুপ্ত। নবান্নের পরের দিনকে বলা হতো ‘বাসি নবান্ন’। প্রায় বিলুপ্তির পথে। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। ‘মরা’ কার্তিকের পরে শিশির বিন্দুর ছোঁয়া নিয়ে আসা অগ্রহায়ণের শুরু থেকে বাংলায় চলে নবান্নভিত্তিক উৎসবের নানা আয়োজন। নতুন ধানকাটা আর সে ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। এটি সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব। অগ্রহায়ণ এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় হলুদ-সবুজ রঙে। প্রকৃতির এ শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। কারণ কৃষকের ঘর ভরে উঠবে নতুন ধানে। গোলা ভরবে শস্যে। বাঙালীর প্রধান কৃষিজ পণ্য ধান কাটার ক্ষণ। বাঙালীর জীবনে পয়লা অগ্রহায়ণকে তাই বলা হয়ে থাকে বার্ষিক সুদিন। এদিনকে বলা হয় নবান্ন। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নবান্নের দিন থেকে মানুষ গ্রহণ করে নতুন ধানের চাল। এ এক অন্য রকম আনন্দ। বিশেষত গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক জীবনে নবান্নের মাধুর্য সীমাহীন। এ দিনে কৃষকের হৃদয়ে বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। নবান্ন উৎসবের মধ্যে দিয়ে কৃষক ফিরে পায় নতুন জীবন। নতুন দিন। স্বপ্ন দেখে সুন্দর পৃথিবীর। Ñশংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×