ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের  বিচিত্র কর্মজীবন

তৃতীয় অধ্যায় ॥ বাগেরহাটে এক বছর (গতকালের পর) সম্ভবত বিশ্বে তখন শুধু বাগেরহাটেই ন্যারোগ্যজের ট্রেন ছিল, যার ফলে এর জন্য কোন মালবাহী অথবা যাত্রীবাহী ওয়াগন অথবা কোচ অথবা ইঞ্জিন কোথাও পাওয়া যেত না। পুরনো রোলিং স্টকের সংরক্ষণ ও মেরামত ছিল প্রায় অসম্ভব। এর ফলে ট্রেন কোনমতেই নিয়মমত চলত না এবং যেখানে-সেখানে বন্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিলম্বিত হতো। ট্রেনের ইঞ্জিন প্রায়ই গরম হয়ে যেত এবং তখন তাকে ঠা-া করার জন্য সেখানকার অধিবাসীদেরও প্রচুর ট্রেনের ইঞ্জিনে পানি দিতে হতো। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমাকে বহুদিন এই পানি টানার কাজ করতে হয়েছে। ১৯৬১ সালেও এরকম একটি অভিজ্ঞতা হয়, যখন পূর্ব পাকিস্তানের লাট সাহেব আবহাওয়ার কারণে খুলনার পরিবর্তে বাগেরহাটে তার এমফিবিয়ান উড়োজাহাজ নিয়ে অবতরণ করেন। সেই কাহিনীটি পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে বলব। ঐ ট্রেনলাইন সম্বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পরবর্তীকালে আমার হয়। ১৯৬২ সালে রেলওয়ে যখন প্রাদেশিক সরকারের আওতায় আসে তখন আমি নবগঠিত যোগাযোগ বিভাগের উপসচিব নিযুক্ত হই। সেই সময় বাগেরহাটের ট্রেনলাইনটিকে ব্রডগ্যজে পরিবর্তন করার প্রকল্প গ্রহণ করি এবং তার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখি। বলতে ভুলে গেছি যে, বাগেরহাটে এক সময় একটি বস্ত্র মিল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেটা আমার সময়ে মাঝে মাঝে চালু থাকত। ১৯২১ সালে কান্দাপাড়ার উকিল উদ্দিন খন্দকার অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইন পেশা ছেড়ে দিয়ে সেখানে একটি তাঁতকল স্থাপন করেন। সেইটি কখনও ভালভাবে পরিচালিত হয়নি। পরবর্তীকালে নোয়াপাড়ার জমিদার শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ এই মিলটি বর্ধিত এবং স্থানান্তরিত করেন। তার উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে কলকাতা থেকে ঢাকায় হিজরত করা একজন উর্দু ভাষী ব্যবসায়ী এটি খরিদ করেন। আমি সেই মিলের অতি সাদামাটা কিছু কাপড় কিনেছি এবং ব্যবহারও করেছি। কিন্তু মিলটি আমি বাগেরহাট ছাড়ার সামান্য পরেই বন্ধ হয়ে যায়। বাগেরহাটে আমি আরেকটি কাজ করতাম একান্তভাবে আমার কায়দায়। সেখানে অভিযোগ নিষ্পত্তির কাজটি আইনের সাহায্য নিত; কিন্তু নিয়মিত আইনী কায়দায় হতো না। সপ্তায় প্রায় ৪ দিন আমি অপরাহ্নে আমার বাড়ির একটি অফিস কামরায় জনসাধারণের অভিযোগ শুনতাম। সেখানে কোন উকিল বা সহায়কের ভূমিকা থাকত না। অভিযোগকারী তার নালিশ আমার কাছে সরাসরি করত। আমি তার অভিযোগ শুনে বাদী-বিবাদীকে একটি সময় দিয়ে আমার দফতরে ডাকতাম। কোন কোন সময় বাদীর অভিযোগ শেষ হলেই বিবাদীকে সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যেত। আমি দু’পক্ষকে ডেকে তাদের বিবাদের কারণগুলো প্রথমে নির্দিষ্ট করতাম। বেশিরভাগ অভিযোগ থাকত খায়খালাসি জমি বিষয়ক অথবা কোন মেয়ের বিয়ে অথবা অপহরণ বিষয়ে। আমি ভেবে দেখলাম যে, আমি তাদের বিবাদ সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসা করতে চেষ্টা করতে পারি। তবে আমি দেখলাম দুটি আইন আমাকে খুবই বলীয়ান করে তোলে। তার একটি ছিল গড়হবু খবহফবৎং অপঃ। এই আইনে মহাজনদের যারা সুদের ব্যবসা করেন তাদের সনদ নেওয়া ও নিয়ম-কানুন মানার বাধ্যবাধকতা ছিল। চাষী বিপদে পড়ে খায়খালাসি প্রক্রিয়ায় বা দলিল করে টাকা কিছু নিয়ে মহাজনকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমি ব্যবহারের অধিকার দান করে। তারপরে হয় তো তার হাতে টাকা এলে সে আগেভাগেই টাকা সুদসহ ফেরত দিয়ে জমির উপর তার অধিকার ফেরত চায়। কিন্তু মহাজন সেটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে দিতে চায় না। আবার হয় তো কোথাও যথাসময়ে কর্জকারী টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় এবং বেশ কিছুদিন পরে সে টাকা অতিরিক্ত সুদসহ ফেরত দিতে আসে। তখন মহাজন আর তাকে জমি ফেরত দেয় না বা টালবাহানা করে আরো অতিরিক্ত সময় তা ধরে রাখতে চায়। এসব ক্ষেত্রে আমি প্রথমে অনুনয় করে মহাজনকে বলতাম যে, তিনি তো অনেকদিন অধিকার বজায় রেখেছেন। এখন না হয় কিছু অধিক অর্থ নিয়ে সেটি মালিককে ফিরিয়ে দেন। অনুনয়-বিনয়ে কাজ না হলে তাকে গড়হবু খবহফবৎং আইনে শাস্তির কথা শুনিয়ে দিতাম। ঐ আইনে সুদের ব্যবসা করতে গেলে লাইসেন্স লাগে, আর লাইসেন্স না থাকলে তার জেল-জরিমানা হতে পারে। জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে আমি অনেক অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হই। বিয়ে নিয়ে নালিশ হতো যে, মেয়ের বয়স হয়নি অথচ জোর করে তার বিয়ে দেয়া হয়েছে অথবা মেয়ের সম্পত্তির লোভে কোন দুষ্ট লোক জোর করে মেয়েকে অপহরণ করেছে বা বিয়ে করেছে তার পরিবারের অমতে। আবার কোথাও প্রেমের কাহিনীও থাকত, মিয়া-বিবি রাজি; কিন্তু কোন পক্ষের পরিবার সেটা নষ্ট করবেই। তখন ঈযরষফ গধৎৎরধমব আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে করা বা দেওয়া ছিল শাস্তিযোগ্য। মেয়েকে বা বরকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে সঠিক তথ্য নেওয়ার আমি প্রথমে চেষ্টা করতাম। তারপর ১৪ বছরের কম বয়সের মেয়েকে নিয়ে খেলা হচ্ছে বলে আইনের জোরে দুষ্ট লোকদের শাস্তি দেবার ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে বহু অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে আমি সক্ষম হই। তাই তখন থেকেই আমি আইনের বিধান সম্বন্ধে খুবই সচেতন হই এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমার শিক্ষা হয় যে, আইনের অনুশাসন আদর্শবাদী হওয়া ভাল। সেটা যে প্রয়োগ করা হয় না বা প্রয়োগ করা যাবে না সে কারণে সেই আইনটি প্রণয়ন করা কোনমতেই উচিত নয়। সেই বিবেচনায় আমাদের বিয়ের আইনে বর্তমানে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ রাখা অত্যন্ত জরুরি। তার চেয়ে কম বয়সের বিয়েতে গোলমাল হলেই আইনের সাহায্যে তার নিষ্পত্তি করা খুবই সহজ। বাগেরহাটে আমি মাত্র এক বছর ছিলাম এবং সেই সময়ে বাগেরহাটের প্রায় সর্বত্র আমি ঘুরে বেড়াই। আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হচ্ছে ১৯৫৯/৬০ সালের শীতকাল। বাগেরহাটের প্রথম কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল বাগেরহাটের ইতিহাসের একটি বিশেষ মাইলফলক। সম্ভবত দুই মাসব্যাপী যে প্রদর্শনীটি চলে সেখানে কৃষি ও শিল্পমেলা যতটা না আকর্ষণীয় ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকা- তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পায়। রমেশ শীলের কবিগান, আবদুর রহমান বয়াতির জারিগান এবং কয়েকদিনব্যাপী যাত্রার অনুষ্ঠানে লোক সমাগন ছিল ব্যাপক। ঢাকার এবং স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে তিনদিনব্যাপী যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নাটক অনুষ্ঠিত হয় সেটি একটি মফঃস্বল শহরের জন্য ছিল অভাবনীয়। খান আতার নেতৃত্বে একটি অত্যন্ত উত্তম শিল্পী ও অভিনেতা গোষ্ঠী এই অনুষ্ঠানকে দেয় সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা। আমার সৌভাগ্য যে, আমার সময়ে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তার সম্পূর্ণ হিসাব আমার উত্তরাধিকারী মহকুমা হাকিম জওয়াদুর রহিম জাহেদ অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ করেন। আমি বাগেরহাটবাসী এবং তাদের বিবদমান নেতৃবৃন্দ ও জাহেদের কাছে সেজন্য চিরদিনের জন্য ঋণী। চলবে....
×