ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

খালেদার ১৩ দফায়ও জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধী

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

খালেদার ১৩ দফায়ও জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধী

যে যত চেঁচামেচি করুন কিংবা আমাদের সুশীল সমাজ টিভি টক শোতে যত থিওরিই দেন না কেন দেশে এই মুহূর্তে কোন রাজনৈতিক সঙ্কট নেই। কেবল বিএনপি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে যেতে পারবে না বলে প্রথমে দেশব্যাপী গাছ কেটে, রাস্তা কেটেও যখন দেশ অচল করতে পারল না, বরং দেশ ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরে এগিয়ে চলল, তখন দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে পেট্রোল বোমার রাজনীতি শুরু করল। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হলো পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণের প্রতিরোধের মুখে। সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হতে চলল তখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দ-প্রাপ্ত সাঈদীর চেহারা চাঁদের ছবিতে সুপার ইমপোজ করে এবং পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পাল্টানোর ছবিকে কাবা শরীফের খতিবদের সাঈদীর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনের সচিত্র প্রতিবেদন হিসেবে ছেপেও যখন দেখল বুমেরাংÑ আর কি করা যায়? ইস্যু যে তলানিতে। উঠলেন গিয়ে বনানীর কার্যালয়ে বাক্সে-প্যাটরা নিয়ে। পণ করলেন শেখ হাসিনা সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না। এতে শেখ হাসিনার পতন তো দূরের কথা দেশের অন্যতম বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তারই পতন হয়ে গেল। ঘরের সন্তান ঘরে ফিরে গেলেন। গেলেন মাথা নিচু করে এবং পণের কি হলো তাও কেউ জানে না। অবরোধ তুললেন কি তুললেন না কোন ঘোষণাও নেই আজতক। হাল কিন্তু ছাড়লেন না। গোপন শিবির বাহিনীকে নামিয়ে দিলেন ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে। তারা মাঝে মধ্যে একটা/দুটা নাশকতা ঘটাবার চেষ্টা করছে কিন্তু পুলিশ, র‌্যাব-বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধাওয়া খেয়ে এখন আর গর্তেও থাকতে পারছে না। আনসারুল ইসলাম, আনসারুল্লা বাংলা টিম, হিযবুল মুজাহিদীন, হিযবুল্লা কত যে নাম ধারণ করে মুখ ঢাকতে চেয়েছে পারেনি, মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। ॥ দুই ॥ দেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০১৯ সালে। এটি সংবিধানের বাধ্যবাধকতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারতায় তার কিছু আগেও হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঐ নির্বাচনেও কি খালেদা জিয়া বা তার পার্টি বা জোট অংশ নেবে? সম্প্রতি প্রকাশিত বিএনপি’র নতুন কমিশন গঠন সংক্রান্ত ১৩ দফা প্রস্তাবনা পড়লে তাই মনে হবে। খালেদা জিয়া অত্যন্ত কৌশলে আদালত কর্তৃক ঘোষিত সন্ত্রাসী গ্যাং এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধন বাতিলকৃত জামায়াত-শিবিরকে পরবর্তী ২০১৯-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের শর্তজুড়ে দিয়েছেন। শর্তের আড়ালে শর্ত, ১৩ শর্তের আড়ালে প্রায় শত শর্ত। মনে আরও কত শর্ত আছে তা তিনিই জানেন। ॥ তিন ॥ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) রকিব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (পাঁচ সদস্য) মেয়াদ শেষ হবে এবং পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি তারা পদত্যাগ করবেন। তার আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। খালেদা জিয়া ১৯ নবেম্বর ২০১৬ গুলশানের অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেলে নির্বাচন কমিশন গঠনের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে : ১. সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। ২. প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিরূপণের জন্যে সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সকল রাজনৈতিক দলের মহাসচিব অথবা সাধারণ সম্পাদক কিংবা মনোনীত প্রতিনিধির সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করবেন। ২.১ এর আরেকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ নিবন্ধনকৃত সকল রাজনৈতিক দল এবং অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী এমন সকল রাজনৈতিক দলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এসব ধারা বা শর্ত বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে তিনি কিছুতেই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী পার্টি (যারা এখন ভিন্ন খোলস ধরেছে) ছাড়বেন না। তাদের কোলে বসেছেন তো বসেছেনই। কে না জানে, বেশি দূরে না গেলেও, ১৯৭৯ সালে কারফিউর মধ্যে যে সংসদ নির্বাচন করেছিলেন তাতে যেমন ছিল মুসলিম লীগের সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলিম (যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্য কারাভোগকালে মারা যান) সাকা চৌধুরী বা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া)’ ভাসুরের নাম নিয়ে লজ্জা লাগে তাই জামায়াত নেতা মও. আবদুর রহিমকে দিয়ে তথাকথিত ইসলামী ঐক্যজোট বানিয়ে পার্লামেন্টে বসানো হয়েছিল। খালেদা জিয়ার আমলে তো কখনো ২জন কখনও ১৮ জনকে পর্যন্ত পার্লামেন্টে বসানো হয়েছিল। মৃত্যুদ- কার্যকর করা কুখ্যাত নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে পর্যন্ত ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লক্ষাধিক মা-বোনের রক্তে লেখা জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। আরেক মিলিটারি এরশাদ তো জাতির পিতার খুনীদের দল বানিয়ে পার্লামেন্টে বসিয়েছিলেন। এভাবে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। যাদের কারণে তিনি ছিটকে পড়লেন তাদের নিয়েই খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠকে বসতে চান। কিন্তু তিনি ভুলে যান মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি-অর্থনীতি-শিল্প-সংস্কৃতির যোগ্য প্রতিনিধি। তার কাছে অসাংবিধানিক ও অন্যায্য দাবি আদায় করা যাবে না। ॥ চার ॥ এখানে মূলধারা সম্পর্কে দু’একটি কথা বলতে চাই। আমরা যারা ৬০-৭০-এর শেষ প্রান্তে সেই আবহমান বাংলা দেখেছি, দেখছি সেখানে মুসলমান, হিন্দু ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী পাশাপাশি এক সমাজে বসবাস করেছি। আমরা দেখেছি সূর্য ওঠার আগে মুসলমান বাড়ির কুলবধূ দীঘির এক পাড়ের ঘাটে গোসল করে মাটির কলসী কাঁখে ‘পানি’ ভরে বাড়ি যাচ্ছে। আরেক পাড়ের ঘাটে হিন্দু বাড়ির কুলবধূ পিতলের কলসি কাঁখে ‘জল’ ভরে নিয়ে যাচ্ছে। তারা দুইজন দুই পাড় থেকে সুখ-দুঃখের কথা বলছে। তারা কিন্তু একই দীঘি থেকে একজন ‘জল’ বলে আরেকজন ‘পানি’ বলে নিয়ে যাচ্ছে, রান্না করছে, খাচ্ছে। কিন্তু দীঘির পানি পানিই রয়ে গেছে বা জল জলই রয়ে গেছে। উৎপাত শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। বাঙালী শেরে বাংলা ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়নের জন্য ১৯৪০ সালে তার প্রস্তাবটি উত্থাপন করলেন। তাতে তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলাসহ বিভিন্ন প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের স্বার্থে ঘধঃরড়হং শব্দটি ব্যবহার করলেন। কিন্তু অবাঙালী নেতা বাংলাকেও করতলগত করার জন্যে ঘধঃরড়হং-এ ঝ শব্দটি তুলে দিলেন। সবচেয়ে ভয়াবহ যে কাজটি করলেন তা হলো তার ঞড়ি ঘধঃরড়হ ঞযবড়ৎু বা দ্বিজাতি তত্ত্ব। গান্ধী নেহরুরা ভাবলেন ভালই হলো, যবনগুলো তো গেল (মৌলবাদী হিন্দুরা মুসলমানদের যবন বলত)। ব্যাস, ভারত ভাগ হয়ে গেল জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ আমি মুসলমান আমার আবাস পাকিস্তান, তুমি হিন্দু তোমার আবাস হিন্দুস্তান বা ভারত। কারও কিছু করার ছিল না। কেবল দীঘির দুই পাড়ের দুই হিন্দু-মুসলিম কুলবধূ চোখের জল মুছতে মুছতে পাকিস্তান বা হিন্দুস্তানে চলে গেল। ॥ পাঁচ ॥ জিন্নাহ মিয়ার দ্বিজাতি তত্ত্বের সুদূরপ্রসারী আগ্রাসন ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। প্রথমেই তারা ভাষার ওপর আঘাত হানল। কিন্তু বাঙালী রক্ত দিয়ে তা প্রতিরোধ করল। আসল ১৯৫৪ নির্বাচন, তারা পরাজিত হলো। তবু শাসন-শোষণ তাদের হাতে রাখতে রাখতে দিল মার্শাল ল’। দীর্ঘ ২৩ বছর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করল, রক্ত দিল, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৬+১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থান শুরু হলো, মিলিটারি আইয়ুব-ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চাইল, পারল না, বঙ্গবন্ধু মুক্ত হলেন; ৭০-এ নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এবার তারা শুরু করল গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, ঘরবাড়ি, জ্বালিয়ে দেয়া, কিন্তু বাঙালী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করল, ভারত রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়াল, তারা পরাজিত এবং আত্মসমর্পণ করল, আমরা স্বাধীন হলাম। তারপর এল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বরের কালোরাত। জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো ১৫ আগস্ট, চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো ৩ নবেম্বর। খুনী মোশতাক, জিয়া ক্ষমতা দখল করল। আবার আন্দোলন, রক্ত। এবার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে সাহসী, সবচেয়ে দূরদর্শী নেতা। এই আমাদের মূলধারা। বাংলাদেশে যা কিছু হবে মূলধারা অনুযায়ী হবে। সে নির্বাচন কমিশন হোক, নির্বাচন হোক, সরকার হোক, সবই হবে মূলধারায়। ঢাকা : ২৫ নবেম্বর ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব নধষরংংযধভরয়@মসধরষ.পড়স
×