ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সংশোধন দাবিতে সোচ্চার নারী নেত্রীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সংশোধন দাবিতে সোচ্চার নারী নেত্রীরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই দেশে নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে বলে মন্তব্য করেছেন আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের (উই ক্যান বাংলাদেশ) চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। একই সঙ্গে তিনি মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৬ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ১৬ দিনের ক্যাম্পেন কর্মসূচীর অংশ হিসেবে নিঃশঙ্ক জীবন চাই, চাই নারী নির্যাতনমুক্ত সমাজের অধিকার শীর্ষক মানববন্ধন শেষে সংগঠনটির অবস্থানপত্র প্রকাশের জন্য আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছিলেন সুলতানা কামাল। এ সময় সংগঠনটির সদস্য সচিব জিন্নাত আরা হক, এমডি আকতার, ফৌজিয়া খন্দকার, সদস্য বনশ্রী মিত্র নিয়োগী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সুলতানা কামাল বলেন, নতুন আইনানুযায়ী ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ ১৮’র নিচে মেয়েদের বিয়ে দেয়া যাবে বলে যে আইন পাস হয়েছে এটা সাংঘর্ষিক। মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া এ আইন আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। এছাড়া অবিলম্বে এ আইন পরিবর্তনের দাবি করছি। কেননা বাল্যবিয়ে ক্রমশ বাড়ছে, কমছে না। এমতাবস্থায় পাস হওয়া এ আইনের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে রোধ নয় বরং আরও বাড়বে। তিনি বলেন, মেয়েরা সাধারণত ১২ বছর বয়স থেকেই গর্ভধারনের উপযুক্ত হয়। তাহলে যে মেয়েটি অনাকাক্সিক্ষত কারণে ১৪ বছর বয়সে গর্ভধারণ করবে সেখানে এ আইন কি ভূমিকা রাখবে। এছাড়া আইনের মধ্যে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। ফলে মেয়েদের জীবনে সুরক্ষার ফলে আরও দুর্ভোগ নেমে আসছে। রিশা, শারমিন ও তনুর ঘটনা উল্লেখ করে সুলতানা কামাল বলেন, বখাটেদের কারণে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঝরে যাচ্ছে নারীর জীবন। এছাড়া নারীর উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্ল্যানেট ফিফটি ফিফটি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু নারীরা যদি প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার পাওয়া উপহাসে পরিণত হবে। এছাড়া তিনি পুরস্কার পেয়েছেন নেতা হিসেবে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে। আর এ যদি অবস্থা হয় তাহলে আমরা জবাবদিহি করছি কার কাছে? আমরা অবিলম্বে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও পরিস্থিতি বিশ্নেষণে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। বরং বিচারহীনতার কারণে নির্যাতনের ভয়াবহতা ও নৃসংশতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীদের সুরক্ষা না থাকায় নারী নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-২০১৫ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে নারী নির্যাতন ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। নির্যাতিত নারীর মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। প্রকাশকৃত নির্যাতিত নারীদের মাত্র ৩ শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেয়। এর ভেতরে ১০ শতাংশের কোন শাস্তিই হয় না। মূলত সরকারের তথ্য এই হলে বাস্তব চিত্র আরও ভয়ানক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি নৃসংশতার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হয়নি ও দোষীদের খুঁজে বের করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি। উই ক্যান বাংলাদেশের চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ বর্তমানে এক সম্ভাবনার দেশে হিসেবে স্থান পেয়েছে। যার অন্যতম কারণ নারীর অবদান। অথচ এদেশের নারী ঘরে বাইরে সকল সম্পর্কে, সকল বয়সে, শ্রেণী ধর্ম নির্বিশেষে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী গত ৯ মাসে ১৫২ নারীকে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ৩০১ নারীকে ধর্ষণ, ২৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৪৯ নারী। যৌন উত্ত্যক্তকরণে আহত হয়েছেন ১১১ নারী। এছাড়া ২৮ নারী এ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। এসব নারীদের বয়স ৬ বছরের নিচে থেকে শুরু করে ও ৩০ বছরের উর্র্ধে পর্যন্ত। এর মধ্যে আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে যেসব ঘটনা দেখি এর বাইরের অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে। পুরুষরা নারীদের যখন খুশি তখন যে কোন কারণ দেখিয়েই নির্যাতন করে থাকে। আমরা প্রায় ১০ লাখ লোককে চেঞ্জমেকার হিসেবে কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছি। যারা সমাজ থেকে নারী নির্যাতন বন্ধে নিজেদেও মধ্যে পরিবর্তন আনছেন ও অন্যদের নিয়ে কাজ করছেন। সংবাদ সম্মেলনে দুর্বৃত্তের হাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের মেধাবী ছাত্রী রিশার বাবা রমযান আলী ও রিশার মা উপস্থিত ছিলেন। রমযান আলী তার মেয়ের মতো যেন আর কোন মায়ের বুকের সন্তানকে এমন নির্মমভাবে বখাটেদের হাতে মৃত্যু বরণ করতে না হয় এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য রিশার হত্যাকারীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার দাবি করেন। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পা হারানো বাবার কথা তুলে ধরে শারমিন বলেন, আমার কারণে বাবা তার পা হারিয়েছেন। আমি মনে করি এজন্য আমিই দায়ী। আমার জন্য পরিবারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বখাটেদের প্রতিবাদ করায় বাবা আজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাঁদছে। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে, সব বখাটেদের শাস্তি দাবি করছি। এ দেশে যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয় তাহলে আমার বাবার নির্যাতনকারীদের কেন বিচার হবে না। অবিলম্বে সব বখাটেদের দ্রুত বিচার দাবি করছি। সম্মেলনে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক, রাজনৈতিক নেতা, প্রাশাসনিক কর্মকর্তা বিচার বিভাগীয় ও আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। সেগুলো হচ্ছেÑ নারী নির্যাতন প্রশ্নে সরকারের জিরো টলারেন্স অবস্থান বাস্তবে অর্থবহ করা, নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের যথাযথ শাস্তির জন্য দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নারীর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজের সব নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে জনসমক্ষে তার দৃষ্টান্ত স্থান করা, নারীর অগ্রগতির প্রশ্নে সব আইন, সনদ ও নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।
×