ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শীতে খেজুরের রস

পাটালি গুড়, পায়েস পিঠা ও সন্দেশের স্বাদই আলাদা...

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

পাটালি গুড়, পায়েস পিঠা ও সন্দেশের স্বাদই আলাদা...

সমুদ্র হক ॥ খেজুরের গুড় এবং পাটালি গুড় ও সন্দেশের স্বাদই আলাদা। বাঙালীর আপন এই আবিষ্কার পরম গৌরবের। কাঁটাময় শুকনো খড়ি মার্কা গাছের বুক চিড়ে সুমিষ্ট যে রসধারা গভীর যতনে বাঙালীর হাতে উদ্গত হয়ে আসছে আবহমান কাল ধরে তার তুলনা নেই। এই রস ফুটিয়েই তৈরি করা হয় গুড়। আর এই গুড়ে তৈরি হয় কতই না পিঠা পায়েস। খেজুরের গুড় দুধে মিশিয়ে তার মধ্যে চিতই পিঠা ছেড়ে রাত ভর রেখে সকালে খাওয়ার যে স্বাদ ও আনন্দ তা ভোলাই যায় না। পিঠার ভুবনে রাজা হয়ে আছে এই দুধপিঠা। খেজুরের গুড়ের মূল উপাদান খেজুর গাছের রস সংগ্রহ নিয়ে কয়েক ধাপের যে আয়োজন তা আরেক যজ্ঞ। বাংলায় গুড় শব্দটির বয়স দেড় হাজার বছর। প্রভাত রঞ্জন সরকারের শব্দ চয়নিকা বইতে আছে, এটি প্রাচীন বৈদিক শব্দ। সংস্কৃতিতে পাটালি গুড়কে বলা হয় গুড়পট্ট। গুড় চন্দ্রিকা বলা যেতে পারে। এই গুড় কথাটি বলা যত সহজ তৈরি করা তত সহজ নয় মোটেও। রসের জন্য প্রথমে দরকার গাছি। যারা কোমড়ে মোটা রশি বেঁধে খেজুর গাছের ডগায় উঠে ধারালো কাঁচি দিয়ে কিছু অংশ ছিলে ছেনি দিয়ে ছিদ্র করে রস বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় তাদের বলা হয় সিউলি, আবার কোন অঞ্চলে বলে গাছি। এরাই গাছের ডগায় কলসি বা ঠিলা আটকে আসে। রাতভর রস ঝরে কলসিতে ভরে। ভোরে তা নামিয়ে আনে সিউলিরা। তাদের দক্ষতা ও নৈপুণ্য আরেক শিল্পকর্ম। গাছ বেখেয়ালে কাটাকাটি করলেই বিপদ। গাছ শুকিয়ে মরে যায়। গাছ বেড়ে ওঠার অন্তত পাঁচ বছর পর এভাবে কাটা হয়। ঠিকমতো কাটলে একটি গাছ থেকে ২০ বছর রস মেলে। এই রসেরও রকম ফের আছে। গাছ কাটার পর প্রথম দিনের রসকে বলা হয় ডাগারকাট রস। কোথাও বলে নলিয়ান। এই রসের ঘ্রাণ চমৎকার। পরপর তিন দিনের বেশি রস নামনো যায় না। পরের তিন দিন গাছকে বিশ্রাম দিতে হয়। বিশ্রামের এই তিনদিনকে বলা হয় জিরান। কোথাও শুকান। জিরানের পর প্রথম দিনের রস জিরানকাট পয়লা কাটের রস নামে পরিচিত। দ্বিতীয় দিনে দ্বো-কাট। শেষের দিন বা তৃতীয় দিনে তে-কাট। জিরান কাটের রস দিয়ে তৈরি হয় উন্নতমানের গুড়। তারপর দ্বো-কাট ও তে-কাট। রাতের রসের নাম ঝরা। দিনের রসের নাম ওলা। দিনের রস কিছুটা টক। পান করলে কিছুটা বিপদ। রাতের রস শীতল মিষ্টি। রস সংগ্রহের রাতে বৃষ্টি হলেই বরবাদ। ঘন কুয়াশায় রসের স্বাদ থাকে না। গুড় তৈরিতে এর প্রভাব পড়ে। এ দেশের খেজুর মধ্যপ্রাচ্যর মতো নয়। তারপরও এই খেজুরের রসেই তৈরি হচ্ছে সুমিষ্ট গুড়। খেজুরের গুড় বলতেই আগে নাম আসতো যশোর, খুলনা, মাগুরার। যেখানে খেজুর বাগান আছে অনেক স্থানে। যশোর অঞ্চলে খেজুরা নামের এলাকা খেজুর গাছের জন্য খ্যাত। বর্তমানে এই এলাকাগুলোতে অনেক খেজুর বাগান কেটে মেহেগুনি শিশু সেগুন গাছ লাগানো হয়েছে। খেজুরের গাছে বর্তমানে ভাগ বসিয়েছে রাজশাহী অঞ্চল। যশোরের নড়াইল ঝিকরগাছা এলাকায় যে গুড় বানানো হচ্ছে তা আর আগের মতো নেই। এদিকে রাজশাহীর আরানী, বনপাড়া, ঝলমলিয়া, বানেশ্বর, পুঁঠিয়া, বাঘা, বড়াইগ্রাম এবং নাটোর জেলার কয়েকটি এলাকায় খেজুরের বাগান গড়ে উঠেছে। রাজশাহীর খেজুরের বাগানের ক’জন বললেন, আমের মতো তারাও খেজুরের গুড়ের খ্যাতি আনবেন। ঢাকা এবং বগুড়ার বাজারে খোঁজ খবর করে জানা যায়, খুলনা, যশোর ও মাগুরা অঞ্চলের খেজুরের গুড় পাটালি গুড় খুব একটা মেলে না। ফরিদপুরের খেজুরের রসে তৈরি খ্যাতির মুচিগুড়ও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যশোর মাগুরায় যে পাটালি গুড় তৈরি হচ্ছে তা খুব কমই ঢাকার বাজারে আসে। যশোর মাগুরার পাটালি গুড় স্থানীয়ভাবেই বিক্রি হয় বেশি। খেজুরের গুড় তৈরির কয়েক কারিগর জানালেন, এই গুড় তৈরিতে নারীরা বেশি কাজ করে। প্রতি দশ কেজি রস ফুটিয়ে এক কেজি গুড় মেলে। ঠিকমতো তাপ নিয়ন্ত্রণ না করে রস ফুটিয়ে গুড় বানালে মান ঠিক থাকে না। বেশি ফোটানো হলে গুড়ের রং হয় কালো। ধোঁয়া বেশি হলে ধোঁয়াটে স্বাদ। পুড়ে গেলে তো পোড়া গন্ধে গুড় মুখেই দেয়া যায় না। যিনি গুড় তৈরি করবেন তার হাতযশও থাকতে হবে। তার হাতেই স্বাদ নির্ভর করে। পাটালি গুড়ের সন্দেশের জন্য দরকার দানাদার ঝোলা গুড়। রুটি বা শুকনো খাবারের জন্য ঘন তরল গুড় তৈরি হয়। ঝোলা গুড়ের বড় আড়ত ঢাকার সাভারে। এই গুড় ঠিলা বা কলসি করেই আসে। হালে এই খেজুরের গুড়ের মধ্যে ভেজাল শুরু হয়েছে। খেজুরের গুড়ে চিনির সিরা মিশিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফা লুটছে। বিশেষ কায়দার চিনির সিরা ফিটকারী ও হাইড্রোজ নামের রাসায়নিক উপাদান মিশিয়ে গুড়ের রং ফর্সা ও ওজন বেশি করা হয়। এই গুড় দুধে মেশানোর সঙ্গেই দুধ ছানা হয়ে যায়। বর্তমানে এই ভেজাল গুড়ের পিঠা পায়েস তৈরি করতে গিয়ে ঘরের গৃহিণীরা বেশ বিপাকেই পড়ছেন। গুড় দুধে ছেড়ে দিতেই ফেটে ছানা। ভেজাল গুড়ের মধ্যে আসল গুড় খুঁজে পাওয়াই এখন কঠিন। এর মধ্যেই খেজুরের আসল গুড় খুঁজে নিতে হয়। খেজুরের গুড় বলে কথা...।
×