ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চরজনীর উৎসব শুরু আর্মি স্টেডিয়ামে

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধুর্যে সিক্ত হলো ঢাকার শ্রোতৃহৃদয়

প্রকাশিত: ০৮:২৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধুর্যে সিক্ত হলো ঢাকার শ্রোতৃহৃদয়

মনোয়ার হোসেন ॥ সুরের স্রোতধারায় ধরা দিল আনন্দময় সময়। সন্ধ্যায় শুরু হওয়া সুরের যাত্রা শেষ হলো ভোরে। তাল ও লয়ের উদ্দীপনায় কেটে গেল সুর রসিকদের বিনিদ্র রজনী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধুর্যে সিক্ত হলো শ্রোতার অন্তরাত্মা। সেসব শ্রোতার আগমনে প্রাণের সঞ্চার হলো উৎসবে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার শ্রোতার আগমনে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সরগরম হয়েছে সঙ্গীতাসর। ঝলমলে রূপ পেয়েছে উৎসব। উচ্চাঙ্গের গান, যন্ত্রসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় নৃত্যের সুরতরঙ্গে সিক্ত হয়েছে সঙ্গীত রসিকরা। দেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ও শ্রোতার মনন গড়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত উৎসবের সূচনা দিনটি ছিল এমনই সুন্দর ও বিভাময়। পঞ্চরজনীর শাস্ত্রীয় গানের উৎসবের সূচনা সন্ধ্যায় এমনই মধুর দৃশ্যপটের দেখা মিলেছে। বৃহস্পতিবার হেমন্তের সাঁঝবেলা থেকে ভোর অবধি গান আর তালের মায়ায় মুগ্ধতার বীজ বুনে শুরু হলো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। প্রথম দিনের পরিবেশনা ছিল এবারের আসরের প্রবীণতম শিল্পী বিদুষী গিরীজা দেবীর খেয়াল। আরও ছিল ড. এল সুব্রক্ষ্ম্যণনের বেহালা বাদন, ওস্তাদ আশিষ খাঁনের সরোদের সুর এবং প্রবীণ গোডখি-ির বাঁশি ও রাতিশ তাগড়ের বেহালার সমন্বিত সুর। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত উৎসবের আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। স্কয়ার নিবেদিত উৎসবে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক ব্যাংক। বৃহস্পতিবার শুরু হয়ে সোমবার পর্যন্ত চলবে পাঁচ দিনের ৫৫ ঘণ্টার ধ্রুপদী এ সঙ্গীত সম্মেলন। এতে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশের ১৬৫ শিল্পী। ভারতের শিল্পী সংখ্যা ৮২। শীতের বার্তাবহ অঘ্রানের সন্ধ্যায় শিল্পী ও শ্রোতার অংশগ্রহণের বিচারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের সূচনা হয়। শুরুতেই ছিল ‘রবি করোজ্জ্বল’ শিরোনামের শাস্ত্রীয় নৃত্য পরিবেশনা। নৃত্যশিক্ষক শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় নৃত্যনন্দন দলের ষাট শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল গান ও ভাঙ্গা গানে মণিপুরী, ভরতনাট্যম, ওড়িশি ও কত্থক রীতির রূপায়ন পরিবেশন করেন। নাচের মুদ্রার সঙ্গে বেজে ওঠে ‘বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী’, ‘বিপুল তরঙ্গ রে’, ‘ওই পোহাইলো তিমির রাতি’ গানের সুর। এছাড়াও ছিল ব্রজবুলী ভাষার গান। এরপর উৎসবে ভেসে বেড়ায় বাঁশি ও বেহালার যুগলবন্দী সুরমূর্ছনা। উৎসবে বিভিন্ন দেশের বাঁশি বাজিয়ে সুনাম কুড়ানো শিল্পী প্রবীণ গোডখি-ি। তার বাঁশির সঙ্গে যুগলবন্দীতে ছিলেন ভারতের মিউজিশিয়ানস ফেডারেশনের সভাপতি রাতিশ তাগড়ের বেহালাবাদন। তবলা সঙ্গত করেন রামদাস পালসুল। যুগলবন্দী শেষে ছিল উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। অতিথি হিসেবে ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার হর্যবর্ধন শ্রিংলা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী ও ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সেলিম আর এফ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। উদ্বোধনী বক্তব্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত এবারের উৎসবের বিশেষত্ব হলো প্রবীণ শিল্পী বিদুষী গিরিজা দেবীর পরিবেশনা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপলব্ধি ও তাৎপর্যের বিষয়টি উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিকভাবে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে আনন্দ পেতে কান তৈরি করতে হয়। সেটা তৈরি হয় ধীরে ধীরে ও শুনতে শুনতে। আর যার মধ্যে এই সঙ্গীত ধারার নির্যাসটি ছড়িয়ে যাবে সেই মানুষটি কখনও অসুন্দর কাজ করতে পারে না। এ উৎসব নিয়ে ঢাকার একটি বড় গোষ্ঠী উৎসাহী হয়ে উঠেছে, যাদের আশিভাগই তরুণÑ এটি আশার কথা। এভাবেই আমরা এ উৎসবকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত আসরে পরিণত করেছি। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে দিতে হবে এ উৎসবকে। সে লক্ষ্যে কাজ করছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এ বছর এ উৎসব হবে কি হবে নাÑ এটা নিয়ে আমরা দ্বিধায় ছিলাম। তবে সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এ উৎসব শুরু হলো, এটা খুব আনন্দের ব্যাপার। গুলশান ও শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলার কারণে এই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তরুণরা কেন উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকছে সে বিষয়টির দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। সবাই মিলে সমস্যাকে চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কথা শেষে জঙ্গী হামলার ঘটনার নিন্দা করে কবি তারিক সুজাত রচিত ‘জন্মের আগেই আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী। সূচনা বক্তব্যে আবুল খায়ের বলেন, ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের সুনাম কুড়িয়েছে এই উৎসব উপভোগকারী শ্রোতারা। তিনি আরও বলেন, সংস্কৃতিচর্চার আশ্রয়েই মৌলবাদসহ বিভিন্ন অপতৎপরতা মোকাবিলা করতে হবে। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিস্তারে তিনি অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন যেন দেশের প্রতিটি গ্রামে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক ক্লাব করে দেয়া হয়। দেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেল যদি প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের জন্য বরাদ্দ করে তবে আমাদের উদ্যোগের মাধ্যমে যেসব শিল্পী তৈরি হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান হবে। ঢাকাস্থ ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, এ উৎসবের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান শিল্পীদের একই মঞ্চে এনে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের দুয়ার সবার কাছে খুলে দিতে পারা। আমি বিশ্বাস করি, এ অনুষ্ঠান ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উদ্বোধনী পরিবেশনা শেষে খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন বিদুষী গিরিজা দেবী। সেনিয়া ও বেনারস ঘরানার প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী ৮৭ বছরের গিরীজা দেবী গাইলেন নিজের সবটুকু উজাড় করে। অশীতিপর এই শিল্পীর কণ্ঠে খেয়ে গেল চমৎকার কারুকাজ। স্বরের চড়াই-উতরাইয়ে তিনি মোহাবিষ্ট করেন শুদ্ধসঙ্গীতের অনুরাগীদের। প্রথমেই তিনি পরিবেশ করেন রাগ যোগকোষ। এরপর গেয়ে শোনান রাগ মিশ্র খাম্বাসে ঠুমরি। একটু থেমে টপ্পার পর আরেকটি রাগ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার আজকের সুরলহরী। সেনিয়া ও বেনারস ঘরানার এই কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে তবলায় গোপাল মিশ্র ও সারেঙ্গি সঙ্গত করেন মুরাদ আলি খান। বিদুষী গিরিজা দেবীর পরিবেশনা শেষে সরোদবাদন নিয়ে মঞ্চে আসেন আলাউদ্দিন খাঁর দৌহিত্র ও আলি আকবর খাঁর পুত্র ওস্তাদ আশিষ খাঁ। গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন পাওয়া এ শিল্পীর সঙ্গে তবলা সঙ্গত করেন প-িত বিক্রম ঘোষ। ‘জাসরাঙ্গি’ শিরোনামে খেয়াল যুগলবন্দী নিয়ে মঞ্চে আসেন জয়পুর আত্রৌলি ঘরানার শিল্পী বিদুষী অশি^নী ভিদে দেশপা-ে ও মেওয়াতি ঘরানার প্রখ্যাত শিল্পী প-িত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর। তাদের সঙ্গে তবলা সঙ্গত করেন আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার। প্রথম দিনের আয়োজন শেষ হয় গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত ড. এল সুব্রক্ষ্ম্যণনের বেহালাবাদনের মধ্য দিয়ে। বেহালার অপূর্ব সুর মূর্ছনা সত্যিই মন ভোলানো। ড. এল সুব্রক্ষ্ম্যণনের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত তন্ময় বসু। আজকের পরিবেশনা ॥ আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই ওড়িশি নৃত্য পরিবেশন করবেন বিদুষী মাধবী মুডগাল ও তার শিষ্য আরুশি মুডগাল। দল বেঁধে তবলার বোল শোনাবেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী শিল্পীরা। খেয়াল পরিবেশন করবেন বাংলাদেশের শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। সন্তুরে সুর তুলবেন শিল্পী রাহুল শর্মা। কণ্ঠে দলীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবেন মোহাম্মদ শোয়েব ও তার দল। সেতার পরিবেশন করবেন পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়। খেয়াল পরিবেশন করবেন প-িত উলহাস কুশলকার। উৎসবে নতুন যুক্ত হওয়া ম্যান্ডোলিন বাদনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় দিনের আয়োজন। সঙ্গে থাকবে বাঁশি। পরিবেশন করবেন বংশীবাদক প-িত রনু মজুমদার ও ম্যান্ডোলিনে ইউ রাজেশ। উৎসবে অংশগ্রহণের নিয়ম-নীতি ॥ প্রতি বছরের মতো অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে পাস সংগ্রহ করেছেন উৎসব উপভোগকারীরা। কোন ধরনের ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না উৎসব আঙিনায়। নেই কোন গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা। উৎসব শুরুর প্রথম দুই দিন পর্যন্ত অফসাইট নিবন্ধন চললেও তৃতীয় দিন থেকে এ সুযোগ থাকবে না। প্রতিদিন রাত একটায় বন্ধ হয়ে যাবে উৎসবের প্রবেশ পথ। ভোরে আর্মি স্টেডিয়াম থেকে ফেরার জন্য বাস থাকবে নির্দিষ্ট রুটে।
×