ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের তালিকা করে অভিযানে নামছে

অর্থের জন্য জঙ্গীরা ডাকাতি ছিনতাই করছে, দলে ভেড়াচ্ছে পেশাদারদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

অর্থের জন্য জঙ্গীরা ডাকাতি ছিনতাই করছে, দলে ভেড়াচ্ছে পেশাদারদের

শংকর কুমার দে ॥ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলো সাংগঠনিক কার্যক্রম ও জঙ্গী তৎপরতা চালাতে ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করে অর্থ যোগান দিচ্ছে। পেশাদার ডাকাত ও ছিনতাইকারীদেরও দলে ভেড়াচ্ছে। জঙ্গীরাই আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড-বোমার প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামাচ্ছে পেশাদার অপরাধীদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক জঙ্গীরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এ ধরনের ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বর্ণনা করেছে। পুলিশ ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো যেসব পেশাদার ডাকাত ও ছিনতাইকারীকে দলে ভিড়িয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। জঙ্গীবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি পেশাদার ডাকাত ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যদেরও গ্রেফতার অভিযানে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সূত্র জানায়, জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্য রাশেদ ওরফে কাকলির বাবাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে পাঠানো হয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সে জানায়, তার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। ২০০৪ সালে ঢাকায় আসে সে। সাভারের নবীনগরে সে গেঞ্জি বিক্রি করত। এ সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় জঙ্গী হিমেলের। জেএমবির হিমেলই রাশেদকে সংগঠনের জন্য ডাকাত দলে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। গত বছর দলে যোগ দেয় রাশেদ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে রাশেদ জানায়, সে আশুলিয়া এলাকায় থাকত। সেখান থেকে এসে তেজগাঁওয়ের ডাকাতিতে অংশ নেয়। অপারেশনে তাদের সঙ্গে ছিল নয়ন, তুষার, অপু, হিমেল, কাওসার ও আলমগীর। ডাকাতির পর লুণ্ঠিত মালপত্রের ভাগ চায় সে। তখন নেতারা জানায়, লুণ্ঠিত মালপত্রের বড় অংশ সংগঠনের কাজে দেয়া হবে। কিছু অংশ পরে তাকে দেয়া হবে। তারা গত রমজানের আগে নরসিংদীতেও একটি ডাকাতি করে। গত ১৮ জুলাই তেজগাঁওয়ের পশ্চিম নাখালপাড়ার ৩২৭/১ নম্বর বাড়িতে সেলুন ব্যবসায়ী কাজী মোসতাহের উদ্দিন সেলিমের বাসায় ডাকাতি করে তারা। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানার মামলায় এরই মধ্যে পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয় গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের। গত ১ জুন দক্ষিণ মহাখালীর জিপি-ক ৩০ নম্বর বাড়িতে ডিশ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রাসেলের বাসায় ডাকাতির ঘটনায় বনানী থানার মামলায়ও তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সূত্রমতে, জেএমবি জঙ্গীদের দেয়া জবানবন্দীতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীর তেজগাঁও থেকে গ্রেফতার করেন পুরনো জেএমবির সদস্য কাশেম ওরফে কাউসার ওরফে কাশু, নাজমুল হাসান নয়ন ওরফে নরেশ, রাশেদ ওরফে কাকলির বাবা, সেন্টু হাওলাদার ওরফে জাহিদ, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে শুভ্র ওরফে আকাশ, আবদুল বাছেদ ও জুয়েল সরকার ওরফে সোহরাব ওরফে সরকারসহ আরও কয়েক জঙ্গী সদস্যকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৬৭ ভরি স্বর্ণ, ছয় লাখ টাকা, চারটি পিস্তল, পাঁচটি ম্যাগজিন, ১০ রাউন্ড গুলি, নয়টি চাপাতি, চারটি ল্যাপটপসহ লুটের বিভিন্ন মাল। গত ২৩ অক্টোবর বনানী থানার ডাকাতি মামলায়ও পৃথক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় জঙ্গী কাউসার। জবানবন্দীতে কাউসার জানায়, তুষারের মাধ্যমে ডাকাত দলে যোগ দেয় নাজমুল ওরফে নয়ন। নয়ন ছাড়াও আলমগীর, অপু, হিমেলের সঙ্গে কাউসারের পরিচয় হয়। ডাকাতির আগে নয়নের দায়িত্ব ছিল বাসা রেকি করা। ভাড়া নেয়ার কথা বলে বিভিন্ন বাসায় যেত সে। গত ১ জুন সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা দক্ষিণ মহাখালীতে ডিশ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রাসেলের বাসায় গিয়ে কলিংবেল চাপ দেয়। দরজা খুলতেই সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এ সময় তাদের কাছে দুটি পিস্তল ও চাপাতি ছিল। এরপর মালপত্র লুট করে চলে যায় তারা। লুণ্ঠিত মালপত্র কাউসারের কাছে ছিল। অপর জঙ্গী আবদুল বাছেদ জবানবন্দীতে জানায়, তার বাড়িও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। হিমেলের মাধ্যমে এ দলে যোগ দেয় সে। নিজ এলাকায় দিনমজুরের কাজ করত বাছেদ। ঢাকায় আসে কাজের সন্ধানে। হিমেল তাকে ‘ইসলামের জন্য টাকা সংগ্রহের’ কাজ দেয়ার কথা বলে। বাছেদকে বোঝানো হয়, লুট করলে তা ইসলামের কাজে দিলে পাপ নয়, উল্টো সওয়াব হবে। একই সঙ্গে নিজের অর্থকষ্টও থাকবে না। একই মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তি দেয় আসামি আবু বকর সিদ্দিকও। তার বাড়িও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। সে তেজগাঁওয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সেলিমের বাসায় ঢুকে মালপত্র লুট করে। সেও একই ভাবে ঘটনার বর্ণনা দেয়। বনানীর ডাকাতির মামলায় নাজমুল হাসান নয়ন ওরফে নরেশও আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। কয়েক বছর আগে অন্য মামলায় কারাবন্দী ছিল সে। সেখানেই জেএমবির এক সদস্যের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই জেএমবি সদস্যের মাধ্যমে ডাকাত দলে যোগ দেয় নয়ন। রাজধানী ছাড়াও দেশের কয়েকটি এলাকায় ডাকাতিতে সে অংশ নিয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের টাকার চালানকে টার্গেট করে পুরনো জেএমবি। সুযোগমতো তারা এলাকা রেকি করে অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। এছাড়া বিকাশের টাকা লুট করারও টার্গেট করছে তারা। এরই মধ্যে সাভার, আশুলিয়ায় পুরনো জেএমবি বেশকিছু অপারেশনও করেছে। প্রথম দিকে উত্তরাঞ্চলে পুরনো জেএমবির সদস্যরা ডাকাতি ও ছিনতাই করলেও পরে তারা রাজধানী ও আশপাশ এলাকার জন্য পৃথক কয়েকটি দল তৈরি করে। এ দলের সদস্যরা এরই মধ্যে একাধিক ব্যাংকেও ডাকাতি করেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর একের পর এক শীর্ষ জঙ্গী নেতা ও অর্থ যোগানদাতা নিহত হওয়ার পর চরম অর্থ সঙ্কটে পড়ে গেছে জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা। জঙ্গী তৎপরতা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে এখন তারা বড় ধরনের ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে। কমিশনের ভিত্তিতে পেশাদার ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করছে জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো। পেশাদার ডাকাতদের সঙ্গে জেএমবি সদস্যদের কমিশন ভাগাভাগির এক ধরনের চুক্তি থাকে। সে চুক্তি অনুযায়ী লুণ্ঠিত স্বর্ণালঙ্কার ও মালপত্র ভাগাভাগি হয়। জেএমবির প্রায় এক ডজন জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে তারা এ ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করেছে।
×