ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থন চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থন চায় বাংলাদেশ

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মিয়ানমার সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও সমর্থন চেয়েছে বাংলাদেশ। এ সমস্যা দ্রুত সমাধানে মিয়ানমারকে আন্তজার্তিকভাবে চাপ দেয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছে সরকার। তবে ঢাকার বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক ব্রিফিংয়ে এসব আলোচনা হয়। মিয়ানমার সীমান্তের পরিস্থিতি বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ সময় পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকও উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ইত্যাদি মিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ইউএনআরসি, আইওএম, ইউএনএইচসিআর ইত্যাদি সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বিদেশী মিশন ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে মিয়ানমার সীমান্তের পরিস্থিতি তুলে ধরেছি। তবে আমরা এটাও বলেছি, দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে। টেকনাফ থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ চালুর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ তৈরির জন্যও কাজ করছি। আমরা বিসিআইএম উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছি। তবে এরই মধ্যে সীমান্তে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে তাদের বিস্তারিত জানিয়ে এ বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদেশী কূটনীতিকরা বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। বিদেশী কূটনীতিকদের ব্রিফিংয়ের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে এক ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, মিয়ানমারের নতুন এনএলডি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশ দেশটির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার বার্তা দিয়েছে। তবে মিয়ানমার সীমান্তে গত ৯ অক্টোবর সন্ত্রাসীদের হামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ওই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে দেশটিকে সহযোগিতা করে আসছে। ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, মিয়ানমারে রাখাইন মুসলিম সম্প্রদায়ের বাংলাদেশে ক্রমাগত প্রবেশ ঘটছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী রোহিঙ্গাদের প্রবেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও তারা কোন না কোনভাবে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে প্রবেশ করছে। সেখানের মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেন বাংলাদেশে আসতে বাধ্য না হন, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বিদেশী কূটনীতিকদের এ বিষয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন প্রত্যাশা করেন। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যারা আসতে বাধ্য হয়েছেন তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য উদ্যোগে সকলের সহযোগিতা চান তিনি। ব্রিফিংয়ের সময় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের এ ঘটনায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শক্তভাবে বলেছে বাংলাদেশ। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিদেশী কূটনীতিকদের মিয়ানমার বিষয়ে অবহিত করবেন। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেÑ এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা অত্যন্ত দুর্গম। ফলে রোহিঙ্গা প্রবেশ ঠেকানো এত সহজ নয়। আবার কিছু কিছু ঘটনা আছে, যেখানে একান্ত মানবিক কারণে ঢুকতে দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, গত বুধবার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ও মিয়ানমানের বর্ডার গার্ড পুলিশের আঞ্চলিক কমান্ডার পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশে অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিকদের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের আপাতত উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, মিয়ানমারের অনিবন্ধিত নাগরিকদের ওপর একটি জরিপ চালানো হয়েছে এবং তাদের ডকুমেন্টেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। আগামী মাসের মধ্যে জরিপের তথ্য বিস্তারিত জানা যাবে বলেও তিনি জানান। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় সে দেশের নয় সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২শ’র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করেছে তারা। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এদিকে দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। এ প্রেক্ষাপটে সীমান্তে বাড়তি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে কয়েক শ’ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এ বিষয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। এদিকে মিয়ানমারের শরণার্থীরের আশ্রয় দেয়ার জন্য জাতিসংঘ, এইচআরডব্লিউসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। তিন দশক ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহনকারী বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী নিতে নারাজ। বারবার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগও নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এ শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
×