ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিলিওনিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

বিলিওনিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান

ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতিতে একমাত্র বিলিওনিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান নন। বিলিওনিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের আরও কিছু নজির ইতিহাসে আছে। যাদের শাসনকাল ও পরিণতি হতে পারে ট্রাম্পের জন্য উদাহরণ। বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যান্য বিজনেস মুঘলদের পদচিহ্ন অনুসরণে ট্রাম্পের রাজনীতিতে পা রাখা। তবে বিজনেস মুঘল থেকে রাজনীতির শীর্ষে উঠে আসা ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভাল-মন্দ মিলিয়ে। তাদের কেউ কেউ যেমন ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক সাফল্যকে রাষ্ট্রীয় সাফল্যে রূপ দিয়েছেন। কেউ আবার তলিয়ে গেছেন নানা কেলেঙ্কারির চোরাবালিতে। কেউবা হয়েছেন সামরিক অভ্যুত্থানের শিকার। বৈধ এসব বিলিওনিয়ার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অগাধ সম্পদের অধিকারী হয়েছেন এমন কিছু রাষ্ট্রনায়কের নামও আলোচিত ইতিহাসে। মার্কোজ, ইদি আমিন, রবার্ট মুগাবে কিংবা জ্যাকব জুমার সম্পদের পরিমাণ নিয়ে আছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। তাদের বিলাসী জীবন নিয়ে গল্পের শেষ নেই। আসুন, জেনে নেই বৈধ সম্পদের অধিকারী পাঁচ বিলিওনিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান সর্ম্পকে। লিখেছেন- আকিল জামান ইনু ডোনাল্ড ট্রাম্প (যুক্তরাষ্ট্র) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিলিওনিয়ার ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। যিনি ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হতে যাচ্ছেন। গত ৭০ বছরের মধ্যে তিনিই মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি নির্বাচন পূর্বে কংগ্রেসম্যান সিনেটর বা কোন অঙ্গরাজ্যের গবর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি। এক কথায় তিনি রাজনীতিতে ‘আউট সাইডার’। এই ‘আউট সাইডার’ বিজনেস মুঘল ডোনাল্ড ট্রাম্পই হতে যাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। সেই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এবারই প্রথম কোন ব্যবসায়ীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করল তা নয়। এর আগেও তেল কোম্পানির অধিকর্তা জর্জ ডব্লিউ বুশ বা মাইনিং কোম্পানির নির্বাহী হার্বাট হুভারকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা গেছে। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তারা সবাই বিভিন্ন নির্বাচিত পদে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এ দিক থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যতিক্রম। ৪.৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের মালিক এই ধনকুবের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি রেকর্ডও স্পর্শ করেছেন- তা হলো তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট। আগামীতে তিনি কি করবেন তা এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। পৈত্রিক সূত্রে বিত্তশালী ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে অর্জন করেছেন অভাবনীয় বাণিজ্যিক সাফল্য। পাশাপাশি সেই ’৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে কখনও প্লেবয়, কখনও রিয়েলিটি শোর উপস্থাপক, বিতর্কিত মন্তব্য, ঘটনাবহুল দাম্পত্য জীবন ইত্যাদি কারণে তিনি সব সময়ই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। বলা হয়ে থাকে স্বদেশে তার পরিচিতি কোন রাষ্ট্রপতির চেয়ে কম ছিল না কখনই। এবারের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নিজের মেয়েকে নিয়ে করা বেফাঁস মন্তব্য বা ফাঁসকৃত ভিডিওতে নারীকেন্দ্রিক তার উক্তি ঝড় তোলে বিশ্ব মিডিয়ায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ঘুষ প্রদান, প্রতারণা, বর্ণবাদ ও জাতিভেদ উস্কে দেয়ার। অন্তত ১৫ জন নারী তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। যৌন হয়রানির অভিযোগের উত্তরে তিনি বুক চিতিয়ে বলেছেন এগুলো সব হিলারির চাল এবং এই নারীদের কেউ তার মনোযোগ আকর্ষণের মতো আকর্ষণীয় নয়। সিলভিও বার্লোসকনি (ইতালি) ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় ইতালির তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লোসকনির। দু’জনই বিতর্কিত এবং লাইফস্টাইল নিয়ে আলোচিত। দু’জনের শুরুটাও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। কিন্তু নাম কিনেছেন মিডিয়ায়। বার্লোসকনি তার ভাগ্য গড়েছেন এক টেলিভিশন সংস্থা ক্রয়ের মাধ্যমে আর ট্রাম্পের পরিচিতির মূল ক্ষেত্রটি রিয়েলিটি শো আর ট্যাবলয়েডের শিরোনামে। বার্লোসকনি প্রায় দুই দশক ধরে ইতালির রাজনীতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি আর নারী কেলেঙ্কারির অন্তহীন অভিযোগ। আদালতের আদেশে সাজাপ্রাপ্তও হয়েছেন বার্লোসকনি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে কর ফাঁকি থেকে শুরু করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক পতিতাকে অর্থ প্রদানের অভিযোগ। যদিও আপীল করে তিনি এসব অভিযোগের দায় থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মিলান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে পিএইচডিধারী বার্লোসকনির বর্তমান বয়স ৮০। ৫.৬ বিলিয়ন ডলারের মালিক এই পাঁচ সন্তানের জনক। পেট্টো প্রশেঙ্কো (ইউক্রেন) পেট্টো প্রশেঙ্কোকে বলা হয় ইউক্রেনের ‘চকোলেট কিং’। তিনি ভাগ্য গড়েছেন বেকারি ব্যবসায়। আর এখন তিনি পশ্চিমা সঙ্গীদের নিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়া বিরোধ মেটাতে ব্যস্ত। তাকে বলা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ার ‘কি-ম্যান’। ২০১৪ সালে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই বিলিওনিয়ার ব্যবসায়ী ইউরোপ এবং আমেরিকার পরম মিত্র বলে পরিচিত সারা বিশ্বে। তিনি প্রায়শই বারাক ওবামা ও জো বাইডেনের সঙ্গে মিলিত হন। আবার বিপরীত চিত্রও আছে। তার শাসনামল-এ ইউক্রেন-রাশিয়ান মেলবন্ধন এর ছবিটিও পরিষ্কার বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায়। তবে ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত প্রশেঙ্কোর কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি শিক্ষা নিতে পারেন। তা হলো রাজনীতিতে প্রবেশের পর প্রশেঙ্কোর সম্পদের পরিমাণ কমে যাওয়া। প্রশেঙ্কোর বিরুদ্ধে ফাঁসকৃত পানামা ডকুমেন্টস-এ অভিযোগ উঠেছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানী ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডে নথিভুক্ত করার। কিয়েভ ইউনিভার্সিটি স্নাতক ৫১ বছর বয়স্ক চার সন্তানের জনক এই ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ ঠাঁই করে নিয়েছেন ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিলিওনিয়ারের তালিকায়। থাকসিন সিনাওয়াত্রা (থাইল্যান্ড) টেলি কমিউনিকেশন ব্যবসা তাকে করেছে বিলিওনিয়ার। সামরিক অভ্যুত্থানে অপসারিত হওয়ার আগে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি ছিলেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। বলছি থাকসিন সিনাওয়াত্রা’র কথা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য , তার সম্পদই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কর ফাঁকি দিয়ে ১.৯ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা তার একটি পারিবারিক কোম্পানি তাকে নিয়ে আসে বিতর্কের কেন্দ্রে। যার শেষ পরিণতি সামরিক অভ্যুত্থান ও দেশত্যাগ। দেশত্যাগী থাকসিন এখনও থাইল্যান্ডের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থাকসিন আলোচনায় উঠে আসেন এ ঘোষণা দিয়ে যে ট্রাম্প ও তার মধ্যে অনেক মিল আছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের সংস্কৃতি এক, আর সফল ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতিতে আসেন তখন নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যুক্ত হয় নতুন হাওয়া।’ সত্যি থাকসিনের বর্ণিত এই নতুন হাওয়া ট্রাম্পকে করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তবে ট্রাম্পের পরিণতি থাকসিনের মতো না হলেই রক্ষা। ৬৭ বছর বয়সী থাকসিন বর্তমানে দুবাইতে নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন। তিন সন্তানের জনক এই ধনকুবেরের সম্পদের পরিমাণ ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার। সেবাস্টিযান পিনেরা (চিলি) বলা হয় পিনেরার আর্থিক সাম্রাজ্য চিলির সমগ্র অর্থনীতি জুড়েই বিস্তৃত। দেশের সবচেয়ে বড় এয়ারলাইন, টেলিভিশন সংস্থা, ফুটবল ক্লাব কোলো কোনো’র মালিকানা তার। পিনেরা তার বাণিজ্যিক সাফল্য প্রচারাভিযানে তুলে ধরে ১৯৯০-এর পর প্রথম রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ২০১০ সালে। তার সময়ে চিলির অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ালেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি নিজে হয়ে পড়েন অজনপ্রিয়। এবারের মার্কিন নির্বাচনে পক্ষ বেছে নিতে পিনেরা মোটেও দ্বিধা করেননি। তীব্র সমালোচনা করেছেন ট্রাম্পের। এমনকি নিউইয়র্কে উপস্থিত হয়ে বলেছেন রিপাবলিকানদের ট্রাম্পকে বেছে নেয়া এক বিশাল ট্র্যাজেডি। হার্ডাড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রীধারী পিনোরো বর্তমান বয়স ৬৬। ৪ সন্তানের জনক পিনেরার সম্পদের পরিমাণ ২.৫ বিলিয়ন ডলার।
×