ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

আমরা ক’জন বুশরার জন্য ন্যায়বিচার চাইব

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

আমরা ক’জন বুশরার জন্য ন্যায়বিচার চাইব

মেয়েকে হারোনোর পর বুশরার মায়ের কেটে গেছে ১৬ বছর। বিষণ্ণ বেদনায় কেটেছে দিনরাত। এখনও তার কানে মা ডাক স্বপ্নের ভেতরে এসে ধরা দেয়। কিন্তু বাস্তবে আর আসে না বুশরা। এখনও দরজার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় এই বুঝি মেয়েটি কলেজ থেকে ফিরে আসছে। বলছে মা ভাত খাব। কিন্তু ঘাতকেরা যে তাকে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। যেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসে না। হয়ত রক্ত-মাংসের বুশরা আর ফিরবে না কোনদিন কিন্তু বুশরার সেই মা ডাক, একটু একটু করে বড় হওয়ার নানান স্মৃতি কি করে ভুলবে মা! কোন মায়ের কাছে কি কোন সন্তান মৃত হতে পারে, ভুলতে পারে কি সেই সন্তানের স্মৃতি! ঘাতকেরাও নিশ্চয় পুরুষ ছিল, তারাও হয়ত আজ বুশরার মতো কোন এক মেয়ের বাবা। বাইরে থেকে এসে যদি দেখে তার মেয়েটি কোন কারণে কান্না করছে আদর করে কি তার মেয়েকে কোলে তুলে নেবে না? নিশ্চয়ই নেবে। পৃথিবীর সবচাইতে খারাপ পিতাও যে সন্তানের কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন- এ কথা সত্য। কান্নাই যদি সহ্য না হয় তাহলে মৃত্যু কিভাবে সহ্য করবে একজন বাবা-মা। তারপরও যদি হয় নৃশংস হত্যা, রক্তেরঞ্জিত দেহ পড়ে আছে চোখের সামনে। সন্তান বাদই দিলাম নিজের ভাই কিংবা বোনের এমন দৃশ্য বাস্তবতা থাক কল্পনাতেও কি গা শিহরিত হয়ে ওঠে না। হয়ত বা ঘাতকদের তা হয়নি। ওদের কি মানুষ বলা যায় নাকি দুই পা বিশিষ্ট চার পা-ওয়ালা জীব। তারা শুধু বুশরাকে হত্যা করেনি, হত্যা করেছে একটি পরিবারের স্বপ্নকে। সেই ২০০০ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বাসায় খুন হন রুশদানিয়া বুশরা ইসলাম। আশা ছিল সর্বোচ্চ আদালতে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতে আসামিরা খালাস পেয়েছে। বুশরার মায়ের প্রশ্ন- ‘তাহলে বুশরাকে খুন করল কে? বুশরা কি কখনও ছিল? আমার তো মনে হয় বুশরা নামে কখনও কেউ ছিল না।’ বুকে পাহাড় সমান দুঃখ নিয়ে কথগুলো উচ্চারণ করেন লায়লা ইসলাম। তিনি মেয়ের নানান ভঙ্গির ছবির সঙ্গে বুশরার কবরের ছবিও বাঁধাই করে রেখেছেন। এ ছবিগুলোর মাঝেই তিনি মেয়েকে খুঁজে ফেরেন। বুশরার বাবা ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। মেয়ে মারা যাওয়ার পর সেই শোকে আর কথা বলতেন না। ২০০৩ সালে হঠাৎ একদিন বুকে ব্যথা, এরপর মারা গেলেন তিনি। তখন থেকে একা লড়ে যাচ্ছেন মা লায়লা ইসলাম। যদিও ২০০৩ সালে এ মামলায় তিনজনকে মৃত্যুদ- এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। শুধু কি বুশরা, এ সমাজে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। যদিও আজ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পাল্টেছে, কিন্তু এখনও একের পর এক মায়ের বুক খালি হচ্ছে। একুশ শতকের পরিসংখ্যান বলছে- বাড়ছে ধর্ষণ, খুন, শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ। তাইতো রেহাই পাচ্ছে না পাঁচ বছরের শিশুও। ক’দিন আগেই দিনাজপুরের ঘটনা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ যেন মেয়ে হয়ে জন্মানোর জরিমানা। নইলে আর কী ভুল হয়েছিল শিশুটির। এই শিশুটি একদিন বড় হবে। হয়তো বা বিচারও হবে অপরাধীর। কিন্তু তার মন থেকে এই নৃশংসতার স্মৃতি কি মুছবে কোনদিন? এরকম ঘটনা যত ঘটে তার খুব কম অংশই মিডিয়াতে আসে। বাকিগুলো আড়ালেই থেকে যায়। যেমন আড়ালে চলে গেছে কল্পনা চাকমার অপহরণের বিষয়টি। তিনি ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাইল্যাঘোনার নিজবাড়ি থেকে অপহৃত হন। এ ঘটনাটি দেশ-বিদেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে ও মানবাধিকার এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই ঘটনায় দোষীদের শনাক্ত বা বিচার কোনটাই হয়নি। বাংলা বর্ষবরণে টিএসসিতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত কারও কোন বিচার হয়নি। ঠাকুরগাঁওয়ে তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা, স্কুলছাত্রী রিশা খুন হলো স্কুলের সামনে ছুরিকাঘাতে। মাহমুদা আক্তার মিতু খুন হলেন নিজ সন্তানের সামনে। কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে খুন হন সোহাগী জাহান তনু। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন তিনি। একাধিকবার তার লাশের তদন্ত হয় কিন্তু একেকবার একেক রকম প্রতিবেদন। তনুর পরিবারও ন্যায়বিচার নিয়ে সন্দিহান। এখনও হাসপাতালে ভর্তি খাদিজা আক্তার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। বদরুল নামক এক পাষ-ের এলোপাতাড়ি কোপের আঘাতে তিনি প্রায় মরেই যেতে বসেছিলেন। চিকিৎসকদের প্রাণপণ চেষ্টা ও দেশবাসীর দোয়ায় তিনি এখন অনেকটা শঙ্কামুক্ত। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় ফতোয়ার কবলে পড়ে যে কত নারী অপমানিত, নির্যাতিত এমনকি মৃত্যুবরণ করেছে তার পুরো খবর না জানলেও আজকাল কিছু কিছু খবরের কাগজে আসছে। সন্তানহারা কোন মায়ের কান্নায় ভারি যেন না হয় বাংলার আকাশ। বুশরা, তনু, মিতু, রিশাসহ সব হত্যাকা-ের ও হত্যাচেষ্টার মূল আসামিরা উপযুক্ত সাজা পাক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। [email protected]
×