ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

তৃতীয় অধ্যায় ॥ বাগেরহাটে এক বছর (২৩ নবেম্বরের পর) সাইকেল শীতকালে আমাকে অনেক জায়গায় নিয়ে যেত, বিশেষ করে বাগেরহাট, দৈবজ্ঞহাটি এবং ফকিরহাট থানায়। ফকিরহাট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার একটি ঘোড়া ছিল। সেজন্য তাকে ঘোড়াভাতাও দেওয়া হতো। সে বাস্তবিকই ঘোড়ার সমঝদার ছিল এবং তার ঘোড়াটি ছিল খুবই ছিমছাম ও দ্রুতগতিসম্পন্ন। ফকিরহাটে গেলে প্রায়ই আমি তার ঘোড়া নিয়ে অনেক এলাকা, যেখানে রিকশা যেতে পারতো না সেসব জায়গায় পরিদর্শনে যেতাম। লক্ষ্যস্থল প্রায়ই হতো কোন বিদ্যালয় বা কোন নালিশের অকুস্থল। খুলনা জেলায় সেই সময়ে প্রায়ই গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বাঘ শিকারে যেতেন। আমি বাগেরহাটে পৌঁছার সামান্য ক’দিন আগে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনির এরকম একটি ভ্রমণে আসেন। আমি জানলাম যে, সেই উপলক্ষে শিকারিরা গোটা ৫০ হরিণ শিকার করেছে; কিন্তু কোন বাঘের দেখা পাওয়া যায়নি। বাঘ শিকারের জন্য আমিও অনেক রাত মাচানে কাটিয়েছি। কিন্তু কোনদিনই বাঘের দেখা পাইনি। অবশ্যি আমার সহযোগী শিকারিরা সেই সুযোগে অনেক হরিণ শিকার করেন। খুলনায় কুমিরও শিকার করা হতো। আমি একদিন সুন্দরবনে ভ্রমণকালে দেখলাম যে, একটি কুমির সমুদ্র উপকূলে রামপাল এলাকায় বালুতে রোদ পোহাচ্ছে। আমি এই কুমিরটিকে আক্রমণ করার সুযোগ কোনমতেই ছাড়তে রাজি ছিলাম না। আমার লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ করে আমরা ধীরে ধীরে কুমিরটির দিকে এগিয়ে চললাম। সবশেষে আমি কুমিরটির মাথা লক্ষ্য করে বুলেট ছুড়লাম। কুমিরটিকে আহত করার সুযোগ আমার হয়; কিন্তু আমরা তার কাছে পৌঁছার আগেই সে কষ্ট করে গড়িয়ে গড়িয়ে পানিতে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুদিন পরে জানা গেল যে, একটা মৃত কুমির উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া গিয়েছে। সুন্দরবন এলাকায় হরিণ শিকারে আমার খুব আপত্তি ছিল। বস্তুতপক্ষে হরিণের সুদৃশ্য চোখে চোখ পড়লে কোনমতেই আমি বন্দুকের ট্রিগার টিপতে পারতাম না। অবশ্যি আমার সহযাত্রী শিকারিরা চুপে চুপে কিছু হরিণ সব সময়ই শিকার করত। আমি খুলনা এলাকায় ১৯৭৯ সালে একবার ভ্রমণে যাই এবং তখন বাগেরহাটে প্রায় ১৭ বছর পরে হাজির হই। সেই সময়ে আমার মনে হলো যে, হরিণ শিকার অনেক কমে গেছে এবং সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। শিকার কমে যাওয়ার প্রমাণটি হলো যে, আমি যখন আমার স্টিমারটি নিয়ে বনের দিকে যাই তখন নানা জায়গায় হরিণের দেখা পাই, যারা পলায়নের কোন চেষ্টাই করল না। আমার মনে হলো তারা তখন জানে এরকম স্টিমারের আরোহীরা হরিণ মারে না। জমিদার কিরণ বাবু সম্বন্ধে আগেই বলেছি, সরকারের সব কর্মকা-ে এবং সবরকম সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তিনি একজন উদ্যোগী ব্যক্তি ছিলেন। আমি যখন ৫৯/৬০ সালের শীতকালে কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করি তখন তিনি এই উদ্যোগে অত্যন্ত মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং যাত্রাগান, কবিগান এসব বিষয়ে তিনি ছিলেন বিশেষ আগ্রহী। বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যরা বেশিরভাগই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। তিনি প্রায় একাই সেখানে থাকতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেসব শিল্পী এবং তাদের অভিভাবকবৃন্দ বাগেরহাটে আসেন তাদের বেশিরভাগই কিরণ বাবুর অতিথি ছিলেন। তিনি মাছ শিকারে সবিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং প্রায়ই মাছ শিকারের আয়োজন করতেন। তিনি আমাকে কলারোয়া গ্রামে বেড়াতে যেতে বলেন। এই গ্রামটি ছিল মূলত হিন্দু মৎস্যজীবীর গ্রাম এবং সেখানে ১৯৪৮ সালে বেশ বড় ধরনের একটি দাঙ্গা হয়। এখান থেকেই খুলনার গ্রামাঞ্চলের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নিম্নবিত্তের জনগণ ভারতে পাড়ি দেয়। এই দাঙ্গার সময় সুসাহিত্যিক মোঃ বরকত উল্লাহ ছিলেন মহকুমা হাকিম এবং তিনি দাঙ্গা দমনে তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হন। প্রাদেশিক সরকার তখন খুলনায় নিযুক্ত একজন শিক্ষানবিস সিএসপি কর্মকর্তা এ. এ. শাহকে কলারোয়ার দাঙ্গা দমনে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেন। কিন্তু ১২ বছর পরেও আমি সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নানা নিদর্শন দেখতে সক্ষম হই এবং প্রতিমুহূর্তেই আমাকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভীতি সম্বন্ধে অবহিত করা হয়। আমি কলারোয়ায় এক রাত অবস্থান করি এবং আমার মনে হয় তারা আমাকে অত্যন্ত আপনজন হিসেবে গ্রহণ করে। আমি আমার চাকরি জীবনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হুমকি ৬১/৬২ সালে সামান্য উপলব্ধি করি। তখন বাংলাদেশের লাট সাহেব জেনারেল আজমের আন্তরিকতা ও সাবধানতার ফলে দাঙ্গাটি মোটেই সংঘটিত হলো না। তবে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময়ে আমি বিদেশে ছিলাম বলে সে সম্বন্ধে আমার ধারণা খুবই কম। আমার কাছে দাঙ্গার স্মৃতি হলো শৈশবের এবং কৈশোরের। বস্তুতপক্ষে ১৯৫০-এর পরে আমি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হুমকি শুনেছি; কিন্তু কখনও তা দেখিনি বা তার শিকার হইনি। আমি বাগেরহাটে পৌঁছার প্রায় ৪ মাস পরে একটি কয়লাচালিত ছোট মোটর বোট পাই। আমার বাগেরহাট ভ্রমণের বাহন ছিল এই মোটর বোট। সামান্য কিছু জায়গায় আমার সাইকেল এবং এছাড়া বাকি এলাকায় ডিঙ্গি নৌকা বা শুধু দুটি পা। বাগেরহাটে ন্যারোগ্যজের যে খেলনা ট্রেনটি ছিল তার উপর কখনও নির্ভর করা যেত না এবং সেই ট্রেন দিয়ে সামান্য রাস্তাই যেতে পারতাম। ট্রেনটি নিয়ে মানুষের দুঃখের অন্ত ছিল না। চলবে...
×