ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

অসুস্থ আমেরিকা!

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

অসুস্থ আমেরিকা!

এই লেখাটি যে বা যারা একটু কষ্ট করে পড়বেন, অনুগ্রহ করে তারা যদি জীবনানন্দ দাশের ‘সুচেতনা’ এবং ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’ কবিতা দুটি মাথায় রাখেন, তাহলে এর মর্মার্থ অনুধাবন অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। সত্যি বলতে কী, বর্তমান বিশ্ব ও বৈশ্বিক ব্যবস্থা গুরুতর অসুস্থ। নানা জটিল ও গুরুতর রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রে তা দুরারোগ্য ও অনিরাময়যোগ্য। মেডিকেল টার্ম ধার করে যদি বলি, ইতোমধ্যে এই পৃথিবী ‘কোমায়’ না হোক, অন্তত ‘আইসিইউ’তে ভর্তি, তাহলেও বুঝি অত্যুক্তি হবে না। এহেন দুরবস্থা থেকে পৃথিবীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য কোন দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদলও (এক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কিংবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ) বুঝি অপেক্ষা করে নেই। বরং প্রায় সবাই যে যার ফিকির, স্বার্থ উদ্ধার অথবা ধান্ধায় ব্যতিব্যস্ত। তো কবিরা তো সচরাচর ত্রিকালজ্ঞ, ত্রিকালদর্শী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকেন। আর জীবনানন্দ দাশের মতো অমোঘ ও অপ্রতিহত কবি হলে তো কথাই নেই। আর সে কারণেই বুঝি তিনি সেই কবে, কোনকালে ‘সুচেতনা’ কবিতায় ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।’... তবে জীবনানন্দ কথিত সেই ‘গভীরতর’ অসুখ এখন পৌঁছেছে ‘গভীরতম’ পর্যায়ে। আর তাই ঠিক বুঝতে পারছি না একে ঠিক ‘কোমায়’ চলে যাওয়া বলব, নাকি আপাতত ভর্তি ‘আইসিইউ’তে! যদি বলি, ‘লাইফ সাপোর্টে’, তাহলেই বা কেমন হয়! গত কয়েক মাস ধরে প্রায় সমগ্র বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে নানা জনে নানা কথা বললেও, মোটা দাগে বলা যায়, পৃথিবীর আপাত অসুখ-বিসুখের জন্য এই দেশটি কোন না কোনভাবে দায়ী, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এবং দেশটির প্রায় অপ্রতিহত প্রভাব, যেগুলোর অধিকাংশ নেতিবাচক, তা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি প্রায় সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ও প্রসারিত। কাজে কাজেই সে দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের দিকে বিশ্ব ও বিশ্ববাসী তীব্র কৌতূহল ভরে তাকিয়ে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। তো এতদিনে সেই নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলও সবার জানা হয়ে গেছে। গণমাধ্যমের প্রায় অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে সর্বৈব মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে প্রায় একতরফা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন রাজনীতিতে নবাগত প্রবল বিতর্কিত ধনাঢ্য প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। জনমতের ভোটের যৎসামান্য হেরফের সত্ত্বেও অন্তত ইলেকটোরাল ভোটের ব্যবধানে ট্রাম্পের এই বিজয়কে তো বিপুল বিজয় বলা যেতেই পারে। অন্যদিকে সমধিক জনপ্রিয় ও প্রত্যাশিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারির জন্য এই পরাজয় যেন একেবারে কুইনাইন গেলার মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশেরও লক্ষ কোটি ভক্ত ও অনুরাগী ধরেই নিয়েছিলেন যে, হিলারি ইতোমধ্যে হোয়াইটহাউজে পা রেখে ফেলেছেন এবং রাজনীতিতে একেবারে নবাগত ট্রাম্প তার কাছে ধরাশায়ী হবেন সুনিশ্চিত। তো সেই প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল ট্রাম্প যখন হিলারির মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিলেন, তখন তিনি মৃদু হেসে অভিনন্দন জানানো তো দূরের কথা, এমনকি কাঁদতেও ভুলে গেলেন। নিছক বিমর্ষ বদনে বললেন, এই কষ্ট বুকে বাজবে বহুদিন! পুরনো নথিপত্র খুঁজে দেখতে পাচ্ছি যে, মার্কিন নির্বাচন সম্পর্কে লিখেছিলাম ২০১৫-এর নবেম্বর-ডিসেম্বরে। সেখানে লিখেছিলাম, ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হওয়ার মহড়ায় ডেমোক্র্যাট দল থেকে এগিয়ে আছেন হিলারি ক্লিনটন ও বার্নি স্যান্ডারস। অন্যদিকে, রিপাবলিকান পার্টি থেকে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, জেব বুশ প্রমুখ। ট্রাম্পের জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ সর্বোপরি অভিবাসন বিরোধী কট্টর নীতির বিষয়টিও উল্লেখ ছিল। অন্যদিকে মার্কিনীরা এখনও একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা, সে বিষয়েও ছিল সন্দেহের মনোভাব। অথচ এই মার্কিনীরা স্বদেশ এবং বিদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী-পুরুষ সমতা ইত্যাদির কথা বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে থাকে। আরও লিখেছিলাম, দ্বিদলীয় ব্যবস্থা মার্কিন রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে দ্বিদলীয় বিভক্তি আরও তীব্র রূপ ধারণ করেছে। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি, ব্যক্তিগত আক্রমণও বাদ যায়নি। এরপরও পর পর দুই মেয়াদে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় থাকার পর এখন একজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউসে ঢোকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বাড়তে থাকায় ভোটারদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে আন্তর্জাতিক ইস্যু যেমনÑ আইএস, ইরান, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন। মুসলিম চরমপন্থীদের উত্থান ইস্যুটিকে রিপাবলিকানরা যেভাবে কাজে লাগাতে পারছে, ডেমোক্র্যাটরা সেভাবে পারছে না। যুদ্ধবিরোধী ইমেজ কাজে লাগিয়ে বারাক ওবামা ক্ষমতায় এলেও তিনি যুদ্ধ থামাতে পারেননি। বরং যুদ্ধবাজ হিলারি তা আরও সম্প্রসারিত করেছেন। আরও একটি বিষয় নিয়ে লিখেছিলাম, তা হলো মজুরি। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত ও ভঙ্গুর। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় তা আরও রুগ্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাধারণ মানুষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। গত বছর জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ৭ দশমিক ২৫ সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ১০ দশমিক ১০ ডলার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন কংগ্রেসের প্রতি। তবে রিপাবলিকানদের প্রবল বিরোধিতার কারণে তা করা যায়নি। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ওবামা বলেছিলেন, বিদায়ের প্রাক্কালে ন্যূনতম মজুরি প্রতি ঘণ্টায় ১২ ডলার করে দেয়ার চেষ্টা করবেন। তবে প্রকৃত দাবি ছিল আরও বেশি, ঘণ্টায় ১৫ ডলার। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বার্নি স্যান্ডারস অন্তত তাই বলেছিলেন। সিয়াটল সিটি কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রতিনিধি শামা সাওয়ান্ত, যিনি সোসালিস্ট অল্টারনেটিভ পার্টির সদস্য, শ্রমজীবীদের ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টাপ্রতি ১৫ ডলারের দাবি তুলে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তবে দুঃখজনক হলো, হিলারি পরে আর এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। এর জন্য অনেকে মনে করেন যে, হিলারির পরিবর্তে স্যান্ডারস প্রার্থী হলে ফল অন্যরকম হতে পারত। তবে হিলারি কলকাঠি নেড়েছেন এ ক্ষেত্রেও। এবারের নির্বাচনে আরও যা লক্ষণীয় তা হলো, উপমহাদেশ বিশেষ করে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ ও অন্যত্র যেরকম সহিংস ও কদর্য নির্বাচন হয়ে থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশি। যেমন, ট্রাম্প হিলারিকে বলেছেন ন্যাস্টি উইমেন। অন্যদিকে হিলারি বলেছেন ট্রাম্পকে, ডার্টি ম্যান, কদর্য মানুষ। যে বা যারা মার্কিন গণতন্ত্রের বিউটির কথা বলেন, তারা এবারে এর ডার্টিনেস নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষ করেছেন। ট্রাম্প নিজের মুসলিম বিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ কিছুই গোপন রাখেননি। ব্যক্তিগত স্ক্যান্ডালও তার কিছুৃ কম নেই। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এসবই সাধারণ মার্কিনীরা লুফে নিয়েছে। দলে দলে গিয়ে ভোট দিয়েছে ট্রাম্পকে। কথায় বলে, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। একেবারে রাগী ও দুর্দান্ত কাউবয়, টমবয় অথবা গ্রিংগোর ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েই ট্রাম্প তাবত সুন্দরী রমণীকুল ও ইয়ং আমেরিকানদের মন জয় করে নিলেন। অন্যদিকে হিলারির পক্ষে পড়ে রইল ছিঁচকাদুনে ভোটাররা। হ্যাঁ, নির্বাচনের পর ট্রাম্পকে মেনে নিতে অনেক স্থানে গাড়ি ভাংচুর, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, গুলি ছোড়াছুড়ি, লুটপাট, ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়েছে বটে। ঢাকার গুলশানের আদলে বালিভর্তি ট্রাকও জড়ো করা হয়েছে ট্রাম্প টাওয়ারের সামনে। তবে তাতে তো আর নির্বাচনের ফলাফল উল্টে যাবে না। ট্রাম্প ইতোমধ্যেই আনুষ্ঠানিক বৈঠক সেরে ফেলেছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০১৭ এর ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের সপরিবারে হোয়াইটহাউজে প্রবেশ ঠেকায় কে? ততদিন পর্যন্ত হিলারি ভুগতে থাকুন বিষণœতায়। তবে শেষ রক্ষার টোটকা হিসেবে হিলারি ভক্তরা বাংলাদেশ থেকে হরতাল, অবরোধ জাতীয় কর্মসূচী ধার করে দেখতে পারেন। এ বিষয়ে তাকে সবিশেষ পরামর্শ দিতে পারেন শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত ড. ইউনূস। সম্প্রতি একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম সচিত্র কার্টুনÑ খালেদা জিয়া-হিলারি পাশাপাশি, সংক্ষিপ্ত আক্ষেপ, তুইও গেলি আমিও গেলাম! হায়...! অন্যদিকে হিলারির হারে কিছুটা হলেও স্বস্তি নেমেছে আওয়ামী শিবিরে। নির্বাচনের আগে প্রায় সবাই ট্রাম্পের ঘোর বিরোধিতা করে একবাক্যে তাকে উন্মাদ ও অযোগ্য বলে অভিহিত করেছে। এমনকি রিপাবলিকান দলের অপর প্রার্থী জেব বুশ, স্পীকার পল রায়ান পর্যন্ত তার বিরোধিতা ও তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা পর্যন্ত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ৮ নবেম্বরের পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বিশ্বের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। তিনি দেশের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ার অযোগ্য। প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। তো সেই ট্রাম্প কেন জিতলেন এবং হিলারি কেন হারলেন, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণের মতো এবার তা সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করব। আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৭২.৪ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ বা হোয়াইট। কৃষ্ণাঙ্গ বা আফ্রিকান ১২.৬ %। এশীয় আমেরিকান ৪.৮ %। নেটিভ হাওয়াইয়ান ও প্যাসিফিক দ্বীপবাসী ০.২%। এর বাইরেও রয়েছে হিস্পানিক ও লাতিন আমেরিকান জনগোষ্ঠী, যা মোট জনসংখ্যার ৬.২%। ভোটারদের দেয়া ভোটে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে থেকেও নির্বাচকম-লী বা ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের হিসেবে হেরে গেছেন হিলারি। সিএনএন জানিয়েছে ৫০ অঙ্গরাজ্যের মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে মিশিগানের ১৬টি বাদে ট্রাম্প পেয়েছেন ৩০৬টি এবং হিলারি ২৩২টি। মোট ভোটের মধ্যে হিলারি পেয়েছেন ৪৭.৭% আর ট্রাম্প ৪৭.৫%। তবে মজার ব্যাপার, প্রবল নারীবিদ্বেষী এবং নারী নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিতি পেলেও নারীদের ৫৪ শতাংশ ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেয়ার তথ্য মিলেছে। অন্যদিকে নারী প্রার্থী হলেও হিলারি পেয়েছেন মাত্র ৪২ শতাংশ নারী ভোট। ট্রাম্পের নারীবিদ্বেষের প্রতিবাদে কতিপয় নারী নগ্নবক্ষা হয়ে ভোট কেন্দ্রে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি হিলারির। কেউ কেউ মনে করেন যে, হোয়াইটহাউজে থাকাকালীন মনিকার সঙ্গে ক্লিনটনের অনৈতিক সম্পর্কটি নারী হয়েও ভালভাবে সামাল দিতে না পারায় হিলারির নারী ভোট কমেছে। অন্যদিকে হিলারির কফিনে সর্বশেষ পেরেকটি ঠুকেছেন এফবিআই প্রধান জেমস কোমি। মোটকথা, হোয়াইট ইগো ও সুপ্রিমেসি এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পকে বিজয়ী হতে প্রভূত সহায়তা করেছে। ট্রাম্প সম্পর্কে আমাদের প্রায় এক বছর আগে করা ভবিষ্যদ্বাণীর কথা আগে বলেছি। ‘প্রেডিংক্টিং দ্য নেক্সট প্রেসিডেন্ট: দি কিজ টু দ্য হোয়াইট হাউস-২০১৬’ শীর্ষক বইয়ের লেখক আমেরিকান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এল্যান লিখটম্যান পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পই বিজয়ীর হাসি হাসবেন। আরও বলেছিল চীনের একটি বানর, ভারতের চেন্নাইয়ের একটি মাছ, রাশিয়ার একটি ভালুক এবং নেট সিলভার নামের এক ভোটজ্যাতিষী, যিনি গণনায় সেবারমেট্রিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। এখন দেখা যাক, ট্রাম্প নিয়ে এত শঙ্কা এবং জল্পনা কল্পনা কেন? নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, হিলারি নোংরা ও কুটিল নারী। মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হবে। মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। মানুষের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের দাবি ভুয়া। গর্ভপাত অবৈধ করা উচিত। ইত্যাদি। নির্বাচনের পর ট্রাম্প ইতোমধ্যে ১০০ দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। তাতে তার ঘোষিত মনোভাবের প্রতিফলন ঘটলেও তিনি সবাইকে নিয়ে সবার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে এক আমেরিকা, শ্রেষ্ঠ আমেরিকা পুনর্গঠনের কথাও বলেছেন। সে অবস্থায় আগের উগ্র ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব তাকে পরিত্যাগ করতেই হবে। তাকে বরং আইএস জঙ্গী দমনে অধিকতর দায়িত্বশীল হতে হবে। রাশিয়া-ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নসহ ইরাক ও সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে শান্তি ও শৃঙ্খলা। মধ্যপ্রাচ্যে গৃহীত হিলারির দ্বৈতনীতির অবসান ঘটাতে হবে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকতে হবে ট্রাম্পকে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংলাপ এবং ন্যাটো সম্পর্কে ইউরোপের ভীতি দূর করতে হবে। ভারত ও চীনের সঙ্গে স্থাপন করতে হবে ব্যবসায়িক নৈকট্য ও সম্পর্ক। সর্বোপরি সর্বপর্যায়ে মুসলিম বিরোধী মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। জঙ্গী ও মুসলিমদের এক করে দেখলে হবে না। আশার কথা এই যে, জঙ্গী দমনে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্সের মনোভাবের কারণে ট্রাম্পের আমলে দু’দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলেও হতে পারে। ৮ বছরের শাসনামলে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা বাংলাদেশ সফরে না এলেও ট্রাম্প আসতে পারেন। লেখার শুরুতে জীবনানন্দ কথিত পৃথিবীর গভীরতম অসুখের কথা বলেছিলাম। প্রকৃত পক্ষে বিশ্বের এই অসুখের নাম আমেরিকা। বহু কথিত আমেরিকান বিউটির পরিবর্তে আমরিকান কারসিনোমা। এ এক দুরারোগ্য কর্কট রোগ, যা কেবল সারাতে পারেন আমেরিকার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃবৃন্দ। নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, হিলারি নির্বাচিত হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধাবেন। এখন ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামানোর উদ্যোগ নেবেন? তিনি কি আইএসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে ইরাক ও সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন? মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর এজেন্ডা জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমন। দ্বিতীয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট মোকবেলা। তবে ট্রাম্পের নির্বাচনে ইতোমধ্যেই মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে উদ্বেগের ছায়া নেমে এসেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলে মার্কিন সরকার প্রতিশ্রুত ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্দেহ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদেয় এক কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড ফেরত গেছে বিশ্বব্যাংকের কঠিন শর্তের বেড়াজালে। তবুও, এত কিছু অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস, দোলাচল, হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ-হানাহানি-সংঘাত, প্রাণহানি ও সম্পদহানি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য আমরা জানাব উষ্ণ অভিনন্দন ও শুভকামনা: গুড লাক গ্রিংগো। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিপুল বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে বছরে মাত্র ১ ডলার বেতন নেয়ার ঘোষণা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন চমক। ক্ষ্যাপাটে মানুষেরা চাইলে অনেক সময় পৃথিবীর জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনলেও আনতে পারেন। মনে রাখতে হবে, আমেরিকা লিংকন, ওয়াশিংটন, জেফারসনেরও দেশ!
×