ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গৌতম পাণ্ডে

মঞ্চে মুনীর চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৪ নভেম্বর ২০১৬

মঞ্চে মুনীর চৌধুরী

যে মানুষটির উপস্থিতি থেকে প্রস্থান সর্বত্র কাব্যময়তায় পরিপূর্ণ। যার সৃষ্টি, কর্ম আর জীবনযাপন অতি সাধারণ হলেও স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে ছিল প্রবহমান। তিনি হলেন- স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের নাটক-সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কারিগর মুনীর চৌধুরী। তাঁর নাটকের বিষয়-কাঠামো আর মঞ্চে পরিবেশনের কলাকৌশল স্বতন্ত্র। তাঁর কাব্যময় জীবন, কর্ম ও দর্শনকে দৃশ্যকাব্যে রূপ দেয়া কঠিন এক কাজ। এই কঠিন কাজটি সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন গীতাঞ্জলি ললিতকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক নাট্যকার ও নির্দেশক প্রবীর দত্ত। তিনি ‘মুনীর চৌধুরী’ নামের নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনায়ও দক্ষতার পরিচায় দিয়েছেন। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় গীতাঞ্জলি ললিতকলা একাডেমির যুগপূর্তি অনুষ্ঠানের শেষ দিন সন্ধ্যায় ছিল থিয়েটার অঙ্গন দশম প্রযোজনায় নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইমেরিটাস প্রফেসর আনিসুজ্জামান, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ইমেরিটাস রফিকুল ইসলাম। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে মঞ্চে এলো নতুন নাটক। এজন্য গীতাঞ্জলি ললিতকলা একাডেমিকে ধন্যবাদ জানতেই হয়। নাটকটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন একাডেমির পরিচালক, নাটকটির প্রযোজনা অধিকর্তা মাহবুব আমিন মিঠু। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবিনা আক্তার, মোঃ রাজীব আহমেদ, মোঃ জয় আক্তার সজিব, সম্বিতা রায়, জান্নাতুল ফেরদৌস রশনি, মির্জা সাইফুল ইসলাম সুমন, অক্ষয় কুমার সরকার, মোঃ আলম, সিরাজুল ইসলাম, আজিম আহমেদ সালমান ও মোঃ আবু উবায়দা। নাটকটিতে মুনীর চৌধুরীর জীবনদর্শনের পটভূমিই দৃশ্যকাব্যে রূপায়ণ হয়েছে। এতে উঠে এসেছে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক রচনার ট্র্যাজেডি। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় থেকেই তিনি ঝুঁকে পড়েন নাটকের শিল্প কৌশলের দিকে। ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘চিঠি’ প্রভৃতি নাটক বিশেষ সাফল্য লাভ করলেও জনমানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও প্রশংসা পেয়েছে ‘কবর’ নাটকটি। গভীর জীবনবোধের আলোকে সজ্জিত একাঙ্গ এক নাটক। এদেশের নব-নাট্যান্দোলনের পথিকৃৎ মুনীর চৌধুরীর বুদ্ধিদীপ্ত প্রচেষ্টায় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় এদেশের আত্ম সচেতন ও সমাজ সচেতন নাট্যভাবনার সূত্রপাত ঘটে। তাঁর বহুমাত্রিক নাট্যভাবনার নির্মাণ প্রতিফলিত হয়েছে মৌলিক নাট্যরচনায় ও বিদেশী নাটকের অনুবাদ-রূপান্তরে-যেখানে বেদনার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে কৌতুক বোধ ও এর সঙ্গে সূক্ষ্ম শৈল্পিক প্রতিবাদ। দৃষ্টি উন্মোচনকারী এই নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং সাহিত্য সমালোচক ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, আলশামসদের হাতে অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নির্মমভাবে শহীদ হন। কোথাও তাঁর মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! একুশের প্রথম নাটক ‘কবর’ যাকে অমর করে রেখেছে, তারই কোন কবর নেই। তবে কি ‘কবর’ মুনীর চৌধুরীর জীবনের প্রতিচ্ছবি? মূলত নাটকীয় মুহূর্ত তৈরির মাধ্যমে মুনীর চৌধুরীর জীবনালেখ্যই প্রতিফলিত হয়েছে এ নাটকে। থিয়েটার অঙ্গনের সভাপতি মাহবুব আমিন মিঠুর অভিনয় সবার দৃষ্টি কেড়েছে। এছাড়া সংগঠনের অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের অংশগ্রহণে ছিল প্রাণের ছোঁয়া। নাটকে উঠে এসছে মুনীর চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন, নাট্য ও সাহিত্য রচনা, অধ্যাপনা, ব্যক্তিগত ও বারিবারিক জীবনের নানা দিক। লিলি চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর প্রেম ও বিয়ে এবং কোন এক সময়ে স্ত্রীকে ছেড়ে অজানার পথে অনিচ্ছায় চলে যাওয়া এসব যেন একের পর এক তুলে আনা হয়েছে নাটকে। অল্পকাল ব্যবধানে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর গোটা দুনিয়াব্যাপী শিল্প-সাহিত্যের উদার উঠানে, যখন চিন্তার বিলোড়ন তৈরি হয়েছে তখন বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) সে প্রবণতার প্রভাব ছায়া বিস্তার করেছে অনিবার্যভাবে। শিক্ষিত-সচেতন মানুষ হিসেবে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বিশ্বমননে স্নাত হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় থেকেই তিনি ঝুঁকে পড়েন নাটকের শিল্প কৌশলের দিকে। তাঁর প্রথম নাটক নওজোয়ান কবিতা মজলিস রচিত হয় ১৯৪৩ সালে। তাঁর নাটকে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার নগরকেন্দ্রিক জীবনপ্রবাহ এক কর্মচাঞ্চল্যের অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পেয়েছে। আর পেশাগতভাবে শিক্ষকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় শিক্ষার্থী-অধ্যাপক-প্রক্টর-হাউসটিউটর, সাংবাদিক-উকিল-পুলিশ-ডাক্তার নেতা, রিক্সাওয়ালা দোকানদার-অভিভাবক প্রেমিক-প্রেমিকা প্রভৃতি চরিত্র তাঁর নাটকের ক্যানভাসে অতি সাবলীলতায় জায়গা করে নিয়েছে। ‘মুনীর চৌধুরী’ নাটকে আধুনিক প্রযুক্তির প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে ইতিহাসের অনেক তথ্য-উপাত্ত। নেপথ্যে যাদের সাহচর্যে নাটকটি হয়ে উঠেছে আরও প্রাঞ্জল। তারা হলেন- আলি আহমেদ মুকুল (মঞ্চ পরিকল্পনা), ড. আইরিন পারভীন লোপা (পোশাক পরিকল্পনা), শিশির রহমান (আবহ সঙ্গীত), শামীমুর রহমান (আলো), অরণ্য আলমগীর (ভিডিও), সম্বিতা রায় ( কোরিও গ্রাফি), শুভাশীষ দত্ত তন্ময় (রূপসজ্জা), মনির (সেট নির্মাণ), শিল্পী রফিকুন নবী (প্রচ্ছদ নকশা), মাহবুব আমিন মিঠু (প্রযোজনা অধিকর্তা) এবং প্রযোজনা উপদেষ্টা হলেন- প্রফেসর ইমেরিটাস রফিকুল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ও মঞ্চ সারথী আতাউর রহমান। ছবি: ইবনুল আসেফ জাওয়াদ
×