ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের সফল উদ্ভাবন ॥ ঘরেই আদা চাষ

সাদা এলাচসহ দেশেই ১৩ মসলার ২৮ উফশী জাত উৎপাদন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৪ নভেম্বর ২০১৬

সাদা এলাচসহ দেশেই ১৩ মসলার ২৮ উফশী জাত উৎপাদন

সমুদ্র হক ॥ ঘরে বসেই আদার চাষ করা যাবে। মাটির দরকার নেই। জমিতে যেতে হবে না। যে কেউ আদা চাষ করতে পারবে, যা দিয়ে প্রতি বাড়ির বছরের আদার চাহিদা মেটানো সম্ভব। সাদা এলাচও দেশেই উৎপাদন সম্ভব। রসুন হলুদের উন্নত জাতের অধিক আবাদ করতে পারবে কৃষক। এমন অনেক মসলার উদ্ভাবনে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে দেশের একমাত্র বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র। তাদের উদ্ভাবন মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিলে মসলা আমদানিতে আর বহু কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে না। কেন্দ্র গত কয়েক বছরে নানা জাতের উফশী মসলা উদ্ভাবন করেছে। ১৩ মসলার উচ্চ ফলনশীল ২৮ জাত উদ্ভাবিত হয়েছে, যা ইতোমধ্যে অবমুক্ত করা হয়েছে। যে কোন মৌসুমে পেঁয়াজ আবাদ করা যায় এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছে মসলা গবেষণা কেন্দ্র। উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের মধ্যে রয়েছেÑ পেঁয়াজের ৫, হলুদের ৫, রসুনের ২, মরিচের ৩, আদার ২, মেথির ২, কালিজিরা, গোলমরিচ, ধনিয়া, বিলাতি ধনিয়া, পাতা পেঁয়াজ, আলু বোখারা, গোল মরিচের একটি করে। দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ রসুন আদা হলুদ মরিচ উৎপাদিত হচ্ছে তা দিয়ে বছরের চাহিদা মিটছে না। বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের একেক এলাকার মাটি একেক ধরনের মসলা উৎপাদনের উপযোগী। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র যা উদ্ভাবন করছে তা মাঠপর্যায়ের কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে (বিএডিসি) জানানো হয়েছে। মসলা উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটাতে বগুড়ায় ১৯৯৬ সালে মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। বগুড়া নগরীর প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তরে মহাস্থানগড়ের কাছে শিবগঞ্জ যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে ৭০ একর জায়গায় পরীক্ষামূলক প্লট বানিয়ে মসলার গবেষণা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) নজরদারিতে এ গবেষণা কেন্দ্রটি পরিচালিত। কেন্দ্র গত কয়েক বছরে উফশী নানা জাতের মসলা উদ্ভাবন করছে। বিদেশ থেকে স্যাম্পল এনেও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা গবেষণা করছেন। এমন একটি মসলা সাদা এলাচ। দেশে বর্তমানে সবুজ কালো নীল সাদা বেগুনিসহ ১৩ জাতের এলাচ আমদানি হয়। এলাচ আসে ভারত চীন জাপান নেপাল ভিয়েতনাম থেকে। সবচেয়ে বেশি দাম সাদা এলাচের। সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. আশিকুল ইসলাম জানালেন, বছর দুয়েক আগে বিদেশ থেকে সাদা এলাচের জাত এনে দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় কিভাবে উৎপাদন করা যায় তার গবেষণা চলছে। তিনি আশাবাদী সাদা এলাচ দেশেই উৎপাদন সম্ভব। ড. আশিক জানান, এ কেন্দ্রের বড় সাফল্য আদা উৎপাদনে। আদা চাষে মাটি না হলেও চলবে। ঘরের আঙিনায়, বাসাবাড়ির ছাদে পলিব্যাগ বিছিয়ে তার ওপর নারিকেলের ছোবড়া, ধানের গুড়া (তুষ) কাঠের গুঁড়ো একত্রিত করে চাষের ছোট্ট প্লট বানিয়ে দিন কয়েক রেখে দিতে হয়। এরপর আদা বুনতে হয়। তারপর বিশেষ ধরনের সল্যুশন সার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। এপ্রিল মাস আদা বপনের উপযুক্ত সময়। উৎপাদন হতে সময় নেয় দশ মাস। দেশে আদার চাহিদা বছরে দেড় লাখ টন। উৎপাদিত হয় ৬০ হাজার টন। বাকিটা আমদানি। দেশের কোন এলাকায় কোন ধরনের মসলা উৎপাদন করা যায় তা নিরূপণে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র ও চারটি উপ-আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। আঞ্চলিক মসলা কেন্দ্রগুলো হলো মাগুরা কুমিল্লা ও গাজীপুরে। উপ-আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্রগুলো লালমনিরহাট ফরিদপুর সিলেট ও খাগড়াছড়িতে। প্রতিটি কেন্দ্রের গবেষণালব্ধ ফল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (বারি) নিয়মিত জানানো হয়। দেশে মসলার চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে। প্রতিবছর আমদানি করতে হয় ১৪ লাখ মেট্রিক টন মসলা। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ১৭ লাখ টন। উৎপাদিত হয় ৯ লাখ টন। বাকি পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। মসলা গবেষণা কেন্দ্র সকল মৌসুমে চাষ উপযোগী পেঁয়াজের পাঁচটি উফশী জাত উদ্ভাবন করেছে। বোরো ধান ওঠার পর চারা রোপণ করলে দুই মাসের মধ্যে উফশী পেঁয়াজের ফলন পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে উফশী পেঁয়াজের ফলন মেলে প্রতি হেক্টরে অন্তত ২০ টন। এ পর্যন্ত বারি-১ থেকে বারি-৫ জাতের উফশী পেঁয়াজ উদ্ভাবিত হয়েছে। পেঁয়াজের পাতারও (স্থানীয় ভাষায় ফুলকি) উফশী জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। মাঠপর্যায়ে হলুদের গড় ফলন হেক্টরে প্রায় আড়াই টন। গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবিত উফশী হলুদের জাতে ফলন মেলে প্রতি হেক্টরে ২৫ থেকে ৩০ টন। গত ৫ বছরে বারি-১ থেকে বারি ৫ পর্যন্ত হলুদের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। রসুনের দুটি বিশেষ জাত বারি-৩ ও বারি-৪ উদ্ভাবিত হয়েছে। দেশে রসুনের চাহিদা বছরে সাড়ে ৪ লাখ টন। উৎপাদিত হয় ৩ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করতে হয়। ধনিয়া বিলাতি ধনিয়া মৌরি কালিজিরা গোল মরিচ মেথি আলু বোখারার উফশী জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। কৃষক আবুল হাসান জানালেন, তিনি উফশী রসুনের আবাদ করে লাভবান হয়েছেন। বললেন, এক বিঘা জমিতে রসুনের আবাদে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। প্রায় ৩০ মণ রসুন পাওয়া যায়, যা বিক্রি করে অন্তত এক লাখ টাকা মেলে। আরেক কৃষক বললেন, গত বছর ১০ শতাংশ জমিতে রসুনের আবাদ করে লাভবান হয়েছেন। এ বছর তিনি ৩ বিঘা জমিতে রসুনের আবাদ করেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, গত ১৫ বছরে রসুনের আবাদ অন্তত পাঁচগুণ বেড়েছে। ২০০১ সালে রসুনের আবাদ হয় ৩৪ হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রসুনের আবাদ হয় ১ লাখ ৫১ হাজার ১২ হেক্টরে। পাবনা নাটোর চলনবিল এলাকায় রসুনের আবাদ হচ্ছে বেশি। মসলা গবেষণা কেন্দ্র জানায়, উদ্ভাবিত জাতগুলো মাঠপর্যায়ে পৌঁছানোসহ কৃষকদের মসলা আবাদে উদ্বুদ্ধ করা হলে মসলা আমদানি অনেক কমে যাবে।
×