ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি প্রসঙ্গ ॥ দুই চোরও গ্রেফতার

৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সেই হ্যান্ডব্যাগ উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৪ নভেম্বর ২০১৬

৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সেই হ্যান্ডব্যাগ উদ্ধার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের হ্যান্ডব্যাগ (ভ্যানিটি ব্যাগ) চুরির আলোচিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই চোর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে। শনাক্ত হয়েছে চোর চক্রের এক গডফাদার। তাকে ধরতে অভিযান চলছে। চোর গ্রেফতারের সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে চুরি যাওয়া সেই বহুল আলোচিত হ্যান্ডব্যাগটি। এমন ঘটনায় দেশ-বিদেশে রীতিমতো আলোচনায় চলে এসেছে বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতার বিষয়টি। ব্যাগ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খোয়া গেলেও উদ্ধার হয়েছে দামী মোবাইল ফোন, নোটপ্যাডসহ অত্যন্ত জরুরী জিনিসপত্র ও পাসপোর্ট। ব্যাগ উদ্ধার এবং চোর গ্রেফতার হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত। এছাড়া বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাস বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতার প্রশংসার পাশাপাশি পুলিশকে দাফতরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছে। নেদারল্যান্ডস সরকার এমন ঘটনায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে বার্তা দিয়েছে। আজ বাংলাদেশে ডাচ্ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকেই রাষ্ট্রদূতের কাছে হস্তাস্তর করা হবে চুরি যাওয়া ব্যাগটিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিতেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হ্যান্ডব্যাগ চুরির ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে জোরালো তদন্ত চলছে। যদিও প্রাথমিক তদন্তে ঘটনাটি নিছক চুরি বলেই মনে করছেন তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা। বুধবার বিকেলে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে চোরসহ হ্যান্ডব্যাগ উদ্ধারের পর এমন তথ্যই জানালেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন। তিনি জানান, সামান্য চুরির ঘটনা রীতিমতো দেশ-বিদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ঘটনার পর থেকেই রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল দেশ-বিদেশে। বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসে থাকা বাংলাদেশীদের জন্য ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত লজ্জার। চমকপ্রদ এই চুরির ঘটনাটি ঘটে গত ২১ নবেম্বর। সেদিন ছিল সোমবার। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান রাষ্ট্রদূত লিওনি মার্গারিটা কুলেনারার। তিনি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে সেখানে উপস্থিত হন। অনুষ্ঠানের সময় মোমবাতি প্রজ্বলনের সময় তিনি তার হ্যান্ডব্যাগটি চেয়ারে রেখে যান। এ সময় ব্যাগটি চুরি হয়ে যায়। ফিরে এসে তিনি ব্যাগ না পেয়ে খুবই হতাশ হন। তিনি রীতিমতো আতঙ্ক প্রকাশ করে জানান, ব্যাগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রয়েছে। যা না পাওয়া গেলে তার জন্য খুবই অসুবিধার সৃষ্টি হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়। ঘটনাটি নেদারলান্ডসের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। এই কর্মকর্তা জানান, ব্যাগ উদ্ধারে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। চারুকলায় থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে মূল চোরকে শনাক্ত করা হয়। রুবেল নামে এবং চোরের চেহারার সঙ্গে মিল থাকা অনেক রুবেলকে আটক করা হয়। শেষ পর্যন্ত বাছাই করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ প্রকৃত চোর রুবেলকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। ডিসির সার্বিক নির্দেশনায় অভিযানের ধারাবাহিকতায় বুধবার সফলতা মিলে। উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সকাল নয়টায় রুবেলকে (২০) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার বাড়ি বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ থানা এলাকায়। রুবেল কোন সাধারণ মানের চোর নয়। সংঘবদ্ধ চোর চক্রের সদস্য। তাদের গ্রুপের আরও অন্তত ৮/১০ জন চোর রয়েছে। তারা পোশাকে কেতাদুরস্ত। সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছাড়াও বিভিন্ন অভিজাত অনুষ্ঠানে চক্রটি চুরি করে থাকে। রুবেল ইতোপূর্বে এ ধরনের চারটি চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। চক্রটি এ ধরনের অনুষ্ঠানে বিদেশীদের ব্যাগ চুরি করে থাকে। ঘটনার দিন রুবেল ডাচ্ রাষ্ট্রদূতের কাছাকাছি ছিল। সঙ্গে চোর চক্রের গডফাদারও ছিল। ডাচ্ রাষ্ট্রদূত যখন ব্যাগ চেয়ারে রাখেন, তখনই চোর চক্রের গডফাদার রুবেলকে ইশারা দেয়। ডাচ্ রাষ্ট্রদূত চেয়ার ছেড়ে মঞ্চের দিকে রওনা হন। তখন চোরচক্রের গডফাদার রুবেলকে বলে, ম্যাডামের ব্যাগ নিতে। রুবেল যথারীতি ডাচ্ রাষ্ট্রদূতের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় সেখানে থাকা অন্য লোকজন রুবেলের পরিচয় জানতে চান। তখন চোরচক্রের গডফাদার ও রুবেল নিজেদের ম্যাডামের (ডাচ্ রাষ্ট্রদূত) লোক বলে পরিচয় দেয়। এরপর ভিড়ের মধ্যে এক ফাঁকে ব্যাগটি নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। প্রথমেই তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে অবস্থান নেয়। ঘটনাটি মিডিয়ার ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলে রুবেল বিপাকে পড়ে। চুরির সময় রুবেলের মুখে দাড়ি ছিল। আর চুরির ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনায় আসার পর রুবেল দাড়ি কেটে নিজেকে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে। এরপর রুবেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ব্যাগটি নিয়ে চলে যায় তাদের চক্রের সদস্য বসুন্ধরা শপিং মলের পঞ্চম তলায় অবস্থিত লেভেল-৫ এর বি-ব্লকের ৪৫ নম্বর আই টাচ আই টাচ মোবাইল ফোনের দোকানের কর্মচারী শাওনের (২০) কাছে। ব্যাগে থাকা দুইটি দামী মোবাইল ফোন ও একটি নোটপ্যাড শাওনের কাছে বিক্রি করে দেয়। পুরো টাকা দেয়নি শাওন। বিক্রিত টাকার মধ্যে মাত্র ১০ হাজার টাকা দেয়। বাকি টাকা পরে দেবে বলে দু’জনের মধ্যে চুক্তি হয়। শাওন আগে থেকেই চোরাই মালামাল কিনে থাকে। সে এ চক্রেরই সদস্য। শাওনের কাজই হচ্ছে চক্রের সদস্যদের চুরি করা জিনিসপত্র কেনাবেচা করা। পরে শাওনের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও নোটপ্যাডটি উদ্ধার হয়। শাওন মোবাইল আর নোটপ্যাড কেনার পর পঞ্চম তলা থেকে ব্যাগটি বসুন্ধরা সিটির ভেতরে ফেলে দেয়। ফেলেই সটকে পড়ে শাওন। উপর থেকে ব্যাগ পড়ার সেটির মালিকের সন্ধান চলতে থাকে। এক পর্যায়ে শপিংমলের নিরাপত্তাকর্মীরা ব্যাগটি পাওয়ার পর তার প্রকৃত মালিকের সন্ধান করতে মাইকিং করে। কিন্তু উপযুক্ত মালিক না পাওয়ায় ব্যাগটি বসন্ধুরা শপিংমলের নিরাপত্তা বিভাগের কাছে রক্ষিত থাকে। নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন ব্যাগের ভেতরে কি আছে তা খুলে দেখেননি। পরবর্তীতে ব্যাগটি উদ্ধার হয়। ব্যাগে তিনটি পাসপোর্ট ছাড়া যাবতীয় কাগজপত্র রয়েছে। এ বিষয়ে ডাচ্ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তিনি খুবই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পুলিশের তৎপরতায় রীতিমতো প্রশংসা করেছেন তিনি। দূতাবাস এবং নেদারল্যান্ডস থেকেও তারা ধন্যবাদ বার্তা পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাদের বৈঠকের কথা রয়েছে। বৈঠকের আগেই যাবতীয় আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। বৈঠক শেষে ব্যাগটি রাষ্ট্রদূতের কাছে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। চক্রটি পরিকল্পিতভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে এ ধরনের অনুষ্ঠানে বিদেশীদের জিনিসপত্র চুরি করে কিনা সে বিষয়টি জানতে গভীর অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল হক, মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান, ডিবির দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদসহ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×