ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পচন ধরা অর্থলগ্নি বিশ্বের জন্য হুমকি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

পচন ধরা অর্থলগ্নি বিশ্বের জন্য হুমকি

গত বছর একদল জার্মান শিক্ষাবিদ রাজনীতির ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব নিয়ে তাদের পরিচালিত একটি সমীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। সমীক্ষা চালাতে গিয়ে তারা ২০টি উন্নত অর্থনীতির দেশে ১৪০ বছরে অনুষ্ঠিত ৮শ’ নির্বাচন পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে দেখেন। তারা লক্ষ্য করেন যে এ ধরনের সঙ্কটের পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট দলগুলো ও রাজনীতিকদের ভোটের ভাগ প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তবে অধিকতর নমনীয় ধরনের মন্দার পর এই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। বাস্তবেও ব্যাপারটা তেমনই দেখা গেছে এবং এখনও তা ঘটে চলেছে। তার কারণ আমরা ঠিক একই সঙ্কটের পর্বের মধ্য দিয়ে চলেছি। ২০০৮ সালের পর থেকে লাগাতার অর্থনৈতিক দুর্যোগ দুর্বিপাক ঘটে চলেছে। মাঝখানে থেকে থেকে ঘটছে একের পর এক স্ক্যান্ডাল। এলিটরা কি কি উপায়ে পরস্পরের সঙ্গে যোগসাজশে লিপ্ত হয়ে এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যাতে মূলত এলিটরাই লাভবান হয় তা এর মধ্য দিয়ে নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছে। ২০১০ সাল থেকে প্রায় প্রতিটি মহাদেশে ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটে গেছে। এই কেলেঙ্কারির পেছনে কাজ করেছে দুষ্কর্ম, অযোগ্যতা ও আত্মতুষ্টি। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে যে ওয়েলস ফার্গো ২০ লাখ এ্যাকাউন্ট জালিয়াতি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি ফি আদায় করে নিয়েছে। কেলেঙ্কারির দীর্ঘ তালিকায় এটা হচ্ছে সর্বশেষ সংযোজন মাত্র। এদিকে এ বছরের প্রথম ভাগে পানামা পেপার্সে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস হয়েছে তা থেকে অনেকের পূর্ব বর্ণিত আশঙ্কা সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। আর সেই আশঙ্কা হলো এই যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ ও বিলিয়নিয়াররা ন্যায়সঙ্গত করারোপ থেকে তাদের সম্পদকে আড়াল করার ব্যাপারে যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কর ফাঁকির নানান দোহাই পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সর্বাধিক ধনী ১ শতাংশ ও সর্বাধিক দরিদ্র ৯৯ শতাংশের মধ্যে আস্থার অভাব এত বেশি আর কখনও ছিল না। সব ক্ষেত্রে এলিটরা মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ বিশ্ব অর্থলগ্নি সংস্কৃতির সুযোগ নিয়েই যে এসব দুষ্কর্ম করতে সক্ষম হয়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এসব কুকর্মের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভোটাররা যে নির্বাচনে তাদের এই নেতাদের শায়েস্তা করতে চান তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সুশীল সমাজের ওপর এর প্রভাব এতই বেশি ক্ষতিকর যে একটা নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। তবে কোন পরিবর্তন যদি না ঘটে তাহলে উন্নত দেশগুলোর কাঠামোগত ভিত্তি ঝুঁকির মুখে পড়বে। ডয়েশ্চ ব্যাংকের সমস্যার কথাই ধরা যাক। কিছু অনিয়ম ও বিধিবহির্ভূত কারবারের জন্য ব্যাংকটিকে ১৪শ’ কোটি ডলারের জরিমানার হুমকি দেয়ার পর সম্প্রতি এর শেয়ারের দর পড়ে যায়। ঘটনাটা স্মরণ করিয়ে দেয় কিভাবে ইউরোপ তার নাগরিকদের স্বার্থে নয় বরং ব্যাংকের স্বার্থে তার ঋণ সঙ্কট সামলে নিয়েছিল। ২০০৮ সালের আগে জার্মান সরকার সে দেশের ব্যাংকগুলোকে গোটা ইউরোপের দুর্বল সরকার ও কোম্পানিসমূহকে ঋণ দিতে উৎসাহিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপেও যখন পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেল তখন ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার পাইয়ে দেয়া হলো আর করদাতাদের ওপর আঘাতটা নেমে এলো। সেখানকার সরকারগুলো অর্থলগ্নি ব্যবস্থায় এমনভাবে জড়িত যে তার কাছে ওয়াল স্ট্রিট-ওয়াশিংটন যোগসাজশের ব্যাপারটাও তুলনা করলে বিশুদ্ধ বলে মনে হবে। ইউরোপজুড়ে রয়েছে অসংখ্য রুগ্ন ব্যাংক। কোন কোনটি এখনও সরকারী মালিকানাধীন। সরকারগুলো এসব ব্যাংককে মরতে দেয় না বরং পেছনের দরজা দিয়ে এদের সঙ্কট থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করে এবং এভাবেই পরিস্থিতিটা চিরস্থায়ী রূপ ধারণ করে। সরকারগুলো দাবি করে যে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পরিশোধে সক্ষম করে তোলা নয় বরং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থেই এগুলো করা হচ্ছে। এ জাতীয় ঘটনা থেকে এমন বার্তাই লালন করে তোলা হয় যে প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ধনী ব্যক্তিবর্গ প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর ভেসে থাকতে পারে। এমন ঘটনার পরিণতি গুরুতর। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে ইউরোপের সর্ববৃহৎ ‘বেসরকারী অর্থনীতি’ রয়েছে ইতালিতে। সমীক্ষায় দেখা গেছে ইতালির কালোবাজার দেশের মোট অর্থনীতির ২৭ শতাংশ। গ্রীস, স্পেন ও পর্তুগালও পিছিয়ে নেই। এসব দেশের নাগরিকদের প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা দেয় এবং তারা কর দেয়া, আইনের শাসন মেনে চলার মতো নাগরিক দায়িত্ব পালন বন্ধ করে দেয়। এতে করে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যায়। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×