ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

ইউরোপ উদ্বাস্তু সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

ইউরোপ উদ্বাস্তু সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থ

ফ্রান্স ক্যালেতে গড়ে ওঠা উদ্বাস্ত শিবির ভেঙ্গে দিয়েছে। অসংখ্য তাঁবুর এই শিবিরে ৮ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু ছিল। এদের বেশিরভাগই ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান থেকে আগত। শিবির ভেঙ্গে দিয়ে ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ তাদের ভাষায় জঙ্গল পরিষ্কার করেছে। ব্যাপক পুলিশী অভিযানের দ্বারা এসব উদ্বাস্তু ও দেশান্তরী মানুষকে বাসে তুলে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অনেক উদ্বাস্তু ক্যালেতে থেকে যাওয়ার চেষ্টায় বাসে না উঠে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ফরাসী কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা জঙ্গল শিবির চিরতরের জন্য ভেঙ্গে দেবে এবং উদ্বাস্তুদের ফ্রান্সজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে স্থাপিত প্রায় ৪৫০টি অস্থায়ী অভ্যর্থনা কেন্দ্রে রাখবে। সেখান থেকে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যথাযথভাবে আবেদন করতে পারে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে কথাটা স্রেফ বাত বশ বাত। এতে উদ্বাস্তু সমস্যার স্থায়ী কোন সমাধান হবে না। যেটা হবে সেটা এক সাময়িক সমাধান। প্রকৃতপক্ষে উদ্বাস্তু ও দেশান্তরী মানুষদের নিয়ে গত দেড় বছর ধরে যে সঙ্কট চলছে কোন দেশই তা মোকাবেলা করতে পারছে না এবং চাইছেও না। ইউরোপে এখন উদ্বাস্তু ও দেশান্তরীর সংখ্যা বেশ কয়েক লাখ। এই বোঝাটা কিভাবে ভাগ করে নেয়া যায় তা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ নেতা একের পর এক শীর্ষ বৈঠক করেছেন। কিন্তু তেমন কোন ফল হয়নি। কারণ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। হাঙ্গেরী, সেøাভেনিয়া, চেকপ্রজাতন্ত্র ও পোল্যান্ড সবাই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে ইইউর আলোচনা ভেস্তে দিয়েছে। মাঝারিসংখ্যক উদ্বাস্তু নিতে যেসব দেশ রাজি হয়েছিল তারা অতি ধীরগতিতে উদ্বাস্তু নিচ্ছে। এদিকে উদ্বাস্তুর ঢল অব্যাহত আছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লাখ উদ্বাস্তু স্থল ও সমুদ্রপথে ইউরোপে এসেছে। আসার পথে ৩ হাজার ৬৭১ জন সাগরে ডুবে মারা গেছে। আশ্রমের সন্ধানে অনেকে ফ্রান্স, ইতালি ও গ্রীসে গড়ে ওঠা জঙ্গল শিবিরের মতো বেআইনী বসতিতে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে। জঙ্গল শিবিরগুলো মোটেই থাকার মতো কোন জায়গা নয়। জনাকীর্ণ বস্তির মতো এই শিবিরের ভাসমান মানুষের বেশিরভাগ সুদানী, ইথিওপীয়, ইরিত্রীয়, আফগান ও অন্যান্য দেশের মানুষ। বলতে গেলে সবাই পুরুষ। সামান্য কিছু মহিলা আছে। পানি নেই, পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। সরকার বা জাতিসংঘের ত্রাণ সাহায্য তো আরও পরের কথা। শিবিরে ছিঁচকে চোর প্রচুর। যে অল্প ক’জন মহিলা আছে তাদের সর্বক্ষণ কাটে ভয়ভীতির মধ্যে। ছোট ছেলেমেয়েদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ফরাসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই জঙ্গল শিবিরের ধ্বংসসাধনকে ‘মানবিক দায়িত্ব’ আখ্যায়িত করেছেন। শিবির ধ্বংস করে দেয়ার পর উদ্বাস্তুদের সবাই যে ৪৫০টি অভ্যর্থনা কেন্দ্রের কোন না কোন একটিতে চলে গেছে তা নয়। প্রায় হাজার দুয়েক পুরুষ পালিয়ে ক্যালের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। তাদের লক্ষ্য ইংল্যান্ডে পৌঁছান। ফরাসী কর্তৃপক্ষ ক্যালের জঙ্গল শিবির ধ্বংস করে দিয়েছে বটে তবে ক্যালে উদ্বাস্তু প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতির সার্বিক ব্যর্থতা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সুইডিশ সদস্য মালিন বিজোর্ক। তিনি মনে করেন যে মাসের পর মাস ধরে ইউরোপীয় নেতারা একটি নীতিকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হওয়ার পর এটাই দাঁড়ায় যে উদ্বাস্তু প্রশ্নে ইউরোপের সকল দেশের জন্য অভিন্ন নীতি গ্রহণ করা অসম্ভব। ২৮টি সদস্য রাষ্ট্র কবে একমত হবে তার জন্য ইউরোপীয় নেতাদের অপেক্ষা করে থাকার চাইতে বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসনে আগ্রহী ২০টি দেশের একটি ক্ষুদ্রতর কোয়ালিশন গঠন করাই বরং প্রয়োজন। বিজোর্ক বলেন, ৫০ কোটি লোকের একটি মহাদেশ উদ্বাস্তুদের জন্য বৃহত্তর কোন দায়িত্ব নিতে পারবে না এটা বোধগম্য নয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিজোর্কের দেশ সুইডেন ইইউর অধিকাংশ দেশের তুলনায় মাথাপিছু অধিক সংখ্যক উদ্বাস্তু গ্রহণে রাজি। বিজোর্ক বলেন, ‘আমাদের স্বীকার করতে হবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি এবং তারপর বলছি ‘ঠিক আছে, আমরা এটা চলতে দিতে পারি না।’ পর্যবেক্ষকদের বিবেচনায় উদ্বাস্তু সঙ্কটের ব্যাপকতা অনুধাবন ও সঙ্কট মোকাবেলায় ইউরোপ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ব্যর্থতার কারণে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া দেশান্তরী মানুষের জন্য ২০১৬ সাল এযাবতকালের ভয়াবহতম বছর হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ আগেকার সমস্ত রুট বন্ধ হয়ে গেছে এবং মানব পাচারকারী চক্র সাগর পথে ইউরোপে যাওয়ার নতুন ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিচ্ছে। সূত্র : টাইম
×