ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

ঘরে বাইরে বেসামাল অস্ট্রেলিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

ঘরে বাইরে বেসামাল অস্ট্রেলিয়া

ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে টানা দুই হারে এক ম্যাচ আগেই টেস্ট সিরিজ (২-০) খোয়ানোর পর কেঁপে ওঠে গোটা অস্ট্রেলিয়া। হোবার্টের দ্বিতীয় টেস্টে ভরাডুবি শেষে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথের অনুভূতি, মুখ দেখাতেও লজ্জা পাচ্ছেন তিনি! পদত্যাগ করেছেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) প্রধান নির্বাচক রডনি মার্শ। সাবেক তারকা রিকি পন্টিং জানিয়েছেন, মেধা পাচার হয়ে যাওয়াতেই এই অবস্থা! এজন্য অর্থের লোভটাবে বড় করে দেখছেন তিনি। ঠিক আড়াই দিনেও নয়, বৃষ্টিতে ভেস্তে যাওয়া দ্বিতীয় দিন বাদ দিলে হোবার্টে দুই দিন আর এক সেশনেই হেরে বসে ‘মোড়ল’ অস্ট্রেলিয়া! অথচ সিরিজ বাঁচিয়ে রাখতে স্বাগতিকদের সামনে জয়ের বিকল্প ছিল না। শ্রীলঙ্কা সফর হয়ে টানা নিজেদের শেষ ৫ টেস্টে, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ৫ ওয়ানেডতে হারের পর সত্যি স্মিথদের সামনে এখন মুখ লুকানোর জয়গাটুকো অবশিষ্ট নেই! দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ের দৈর্ঘ্য ছিল ৯৩ ওভার, অর্থাৎ ৫৫৮টি বল। নিজেদের মাঠে এর চেয়ে কম বল খেলে হারের মাত্র তিনটি নজির আছে। যার মধ্যে সর্বশেষটি ৮৮ বছর আগে, সেই ১৯২৮ সালে। ব্র্যাডম্যান যুগের পর অসিরা এই প্রথম এত কম বল খেলে হারল। সব মিলিয়ে ঘরের মাটিতে এটি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বাজে পাঁচ হারের একটি। ‘সত্যি বলতে আমি বিব্রত, লজ্জিত, স্তম্ভিত। আমরা অত্যন্ত বাজেভাবে উইকেট খুইয়েছি। এর কোন জবাব থাকতে পারে না। এখানে বসে আপানাদের সঙ্গে কথা বলতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। ভক্তদের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমরা এখন কেবল শেষ ম্যাচটার দিকেই তাকাতে পারি।’ বলেন স্মিথ। শ্রীলঙ্কা সফরের আগেও আইসিসি টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে ছিল অস্ট্রেলিয়া। এখন তিনে। বৃহস্পতিবার এ্যাডিলেডে শুরু হতে যাওয়া শেষ টেস্টেও হেরে গেলে কেবল ‘হোয়াইটওয়াশই’ নয়, ২০১৩ সালের পর প্রথমবারের মতো র‌্যাঙ্কিংয়ে চারের নিচে (৫-এ) নেমে যাবে কুলিন অসিরা। অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকম-লীর চেয়ারম্যান রডনি মার্শের পদত্যাগপত্র তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয়। খারাপ অবস্থার মধ্যেও তার প্রতি বোর্ডের প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড, প্রধান কোচ ড্যারেন লেহম্যান ও হাইপ্রোফাইল ম্যানেজার প্যাট হাওয়ার্ডের সমর্থন ছিল। মার্শের অধীনে গত বছর বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধার করে অসিরা। সম্প্রতি সময়টা মোটেই ভাল যাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কা সফরে ৩-০তে হোয়াইটওয়াশ হয়ে টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান খোয়ায় স্মিথের দল। এরপর ঘরের মাটিতে টানা দুই হারে এক ম্যাচ আগেই প্রোটিয়াদের কাছে এই লজ্জা। অর্থাৎ টানা পাঁচ টেস্টে হারের লজ্জার রেকর্ড গড়ে তারা। মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোন সিরিজে ৫-০তে ‘হোয়াইটওয়াশ’ হয়! পদত্যাগ করেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) নির্বাচকম-লীর প্রধান রডনি মার্শ। পরিবর্তন আসবে সেটি অনুমিতই ছিল। তাই বলে এতটা? এ্যাডিলেডের তৃতীয় ও শেষ টেস্টের দল থেকে বাদ পড়েছেন পাঁচ ক্রিকেটার! যে তালিকায় আছেন পিটার নেভিল, এ্যাডাম ভোজেস ও জো বার্নসের মতো তারকা। ছেটে ফেলা হয়েছে কলাম ফার্গুসন আর জো মিনেকে। নতুন মুখই চার জনÑ ম্যাথু রেন শ, পিটার হ্যান্ডসকম্ব, নিক ম্যাডিসন ও চাঁদ সাইয়ার্স। পুরনোদের মধ্য থেকে ফেরানো হয়েছে ম্যাথু ওয়েড ও জ্যাকসন বার্ডকে। মূলত ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় হোবার্টের দ্বিতীয় টেস্টে প্রোটিয়াদের কাছে ইনিংস ৮০ রানে লজ্জাজনকভাবে হেরে সিরিজ খোয়ায় অসিরা। তখনই প্রধাণ কোচ ড্যারেন লেহম্যান বলে দিয়েছিলেন, হাতে গোনা চার-পাঁচজন ছাড়া দলে আর কারও জায়গাই নিশ্চিত নয়। কারণ তারা পুরোপুরি ব্যর্থ। নিশ্চিতদের মধ্যে মধ্যে অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ, ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নার, পেসার মিচেল স্টার্ক ও জস হ্যাজলউড অন্যতম। টিকে গেছেন উসমান খাজা আর অভিজ্ঞ স্পিনার নাথান লেয়ন। সর্বশেষ ৩২ বছর আগে ১৯৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়া দল থেকে একসঙ্গে ছয় ক্রিকেটারকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘটেছিল আলোচিত পরিবর্তনের সেই ঘটনা। প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের ভরাডুবির কারণে এ্যাডিলেডে অভিষেক হয়ে যেতে পারে তরুণ ম্যাট রেন শ, পিটার হ্যান্ডসকম্ব ও নিক ম্যাডিসনের। পেসার চাঁদ সাইয়ার্সের অন্তর্ভুক্তি বিশেষজ্ঞ পেসার হিসেবে। তার সঙ্গী করতে ফেরানো হয়েছে পাঁচ টেস্ট খেলা জ্যাকসন বার্ডকে। ২০১৩ সালের পর ফিরেছেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ম্যাথু ওয়েড। নতুন প্রধান নির্বাচক ট্রেভর হন্স বলেন, ‘আমাদের জন্য সময়টা সত্যি কঠিন। প্রতিভাবান হিসেবেই নতুনদের নেয়া হয়েছে। আশা করছি ওরা নিজেদের প্রমাণ করতে পারবে। অভিজ্ঞ ওয়েডের ওপর আস্থা রাখা হয়েছে। স্মিথ-ওয়ার্নারকে নিয়ে প্রশ্ন নেই। ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে গিয়েই কঠিন এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের চরম দুর্দিন চলছে। নির্বাচক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সাবেক কিংবদন্তি গ্রেগ চ্যাপেলকে। তবে এসব পরিবর্তন নাকি সমস্যার সমাধান নয়। এ সংকটের কারণ খুঁজে পেয়েছেন সাবেক অসি অধিনায়ক রিকি পন্টিং। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট নাকি মেধা পাচারের কবলে পড়েছে! এ সমস্যাটা নাকি অনেক আগেই চিহ্নিত করেছিলেন পন্টিং এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সমাধানের কোন উদ্যোগ ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নেয়নি বলেও দাবি সাবেক এই সফল অধিনায়কের। কীভাবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট মেধা পাচারের কবলে পড়েছে, সেটা পরিষ্কার ব্যাখ্যা করেছেন পন্টিং। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা কেউই নাকি অবসরের পর কোচিংকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন না। অল্প পরিশ্রমে বেশি অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকায় সবাই নাকি কোচিং বাদ দিয়ে ধারাভাষ্যকার হিসেবে নাম লেখাচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য দলগুলোতে যারা কোচিং করাচ্ছেন, তাদের ভাল বেতন দেয়া হয় না বলেও জানান পন্টিং। এ জায়গাটাতেই পরিবর্তনের কথা দিনের পর দিন বলে আসছেন পন্টিং, ‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ব্যাপারটা জানে। আমি ১ শ’ বছর ধরে তাদের বিষয়টি বলে আসছি! তাদের উচিত রাজ্য ক্রিকেট কোচদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া এবং তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের এ পেশায় নিয়ে আসা উচিত।’ ইংল্যান্ডের বেলায়ও একই অবস্থা দেখছেন পন্টিং, ‘ইংল্যান্ডও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের কতজন কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িয়েছেন? তারা কোচিংয়ে আসেন না। তারা সবাই মাইক্রোফোনের পেছনে বসে ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছেন। কারণ এখানে তারা বেশি অর্থ পাচ্ছেন। এখানে পরিশ্রমও কম, সময়ও দিতে হয় কম। আমার মনে হয়, এ বিষয়টা দেখা উচিত।’ তবে ধারাভাষ্যকার তথাকথিক বিশেষজ্ঞ বললেও পন্টিং নিজেও কিন্তু ধারাভাষ্যকার হিসেবেই কাজ করছেন। চলতি দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেও তিনি ইংল্যান্ডের একটি টিভি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন!!
×