ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্মূল কমিটির গণশুনানি

সাঁওতালরা তাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত চায়

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

সাঁওতালরা তাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত চায়

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা, ২২ নবেম্বর ॥ সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের সাঁওতালদের ওপর হামলা, লুটপাট ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মঙ্গলবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয়, রংপুর বিভাগীয় ও গাইবান্ধা জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ জয়পুর ও মাদারপুর সাঁওতাল এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তাদের উদ্যোগে মাদারপুর মিশন গির্জার সামনে এক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ৬ সাঁওতালের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তারা হলেন রাফায়েল হাসদা, বারনা টুডু, রিনা মাইতি, কৃষ্ণ মুরমু, ববিতা মুরমু ও বারনা মুরমু। শুনানিতে সাঁওতালরা বলেন, ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এক হাজার ৮৪২ একর জমি রংপুর চিনিকলের আওতায় অধিগ্রহণ করা হয়। তখন থেকে এসব জমিতে উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ওইসব জমিতে মিল কর্তৃপক্ষ আখ চাষ না করে বেআইনীভাবে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে লিজ প্রদান করে। তারা লিজ নেয়ার পর ওইসব জমিতে তামাক, ধান, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতে থাকে। এছাড়া এসব জমিতে ১২টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে প্রভাবশালীরা। সাঁওতালদের দাবি, ১৯৪০ সালের রেকর্ড অনুযায়ী তাদের বাপ-দাদার জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। সাঁওতালরা গণশুনানিতে আরও দাবি জানান, তাদের পিতৃপুরুষের জমিতেই পুনর্বাসন করতে হবে, ঘটনায় জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, বেআইনীভাবে উচ্ছেদে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তারা আরও বলেন, সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি ছাড়া, সরকারী কোন খাস জমিতে তাদের পুনর্বাসন করার উদ্যোগ তারা কখনই মেনে নেবে না। তারা আরও বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন মিলের জমিতে আখ চাষ না হওয়ায় দু’বছর আগে বাপ-দাদার জমি ফেরত দেয়ার কথা বলে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলনে নামানো হয় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনকে। গোবিন্দগঞ্জের সংসদ সদস্যের মদদে সাপামারা ইউপি চেয়ারম্যান আদিবাসী ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি শাকিল আকন্দ বুলবুল, কাটাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক, আদিবাসী ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান বাপ-দাদার জমি উদ্ধারের কথা বলে সাঁওতালদের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকার ইক্ষু খামারের জমিতে চলতি বছরের ১ জুলাই বসতি স্থাপনে সহযোগিতা করে। এ সময় আন্দোলন এবং জমি ফেরত দেয়ার নামে সাঁওতালদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা সাঁওতালদের সঙ্গে বেঈমানি করে তাদের উচ্ছেদের ব্যাপারে চিনিকল কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা শুরু করেন। পরে তারাই ৬ নবেম্বর বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করে তাদের উচ্ছেদ করে। এ সময় পুলিশ বিমল কিসকু (৪০), চরন সরেন (৫০), দ্বিজেন টুডু (৩৫), মাজিয়া হেমব্রম (৫০) সহ ৪ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোককে গ্রেফতার করে। ওই হামলা এবং সংঘর্ষের ঘটনায় শ্যামল সরেন ও মঙ্গল টুডু (৫০) নামে দু’জন নিহত হয়। আহত একজন সাঁওতাল পরবর্তীতে মারা যায়। শুনানিতে সাঁওতালদের বক্তব্য শোনেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক বিচারপতি মোঃ শামছুল হক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট বায়েজিদ আব্বাস, সম্পাদকম-লীর সদস্য সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ, কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী। এ সময় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন গাইবান্ধা জেলা শাখার আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুল হক শাহজাদা, সদস্য সচিব আমিনুর জামান রিংকু, রংপুর সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক সরকার এবং রংপুর বিভাগীয় কমিটির সদস্য মুশফিক রাজ্জাক প্রমুখ। দাবিদাওয়া আদায়ে সাঁওতালদের বিক্ষোভ ॥ গণশুনানি শেষে সাঁওতালরা তাদের বাপ-দাদার জমি ফিরিয়ে দেয়া, উচ্ছেদকৃত জায়গায় অবিলম্বে পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, উচ্ছেদ ও হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে মাদারপুর মিশন গির্জা এলাকায় বিক্ষুব্ধ সাঁওতালরা তাৎক্ষণিক মিছিল করে। মিছিলটি ওই এলাকার পার্শ্ববর্তী সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে। মিল কর্তৃপক্ষের ধান কাটার সিদ্ধান্ত ॥ সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার এলাকায় বসতি স্থাপনকারী সাঁওতালরা জমিতে যে আমন ধান চাষ করেছিল তা কাটার জন্য সাঁওতালদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে জমির পাকা ধান ঝরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক মিল কর্তৃপক্ষ তা কেটে নিয়ে তালিকা মোতাবেক সাঁওতালদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
×