ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফেরত পাঠানো সত্ত্বেও গোপনে ঘটছে অনেক অনুপ্রবেশ

রোহিঙ্গা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেই, প্রাণভয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

রোহিঙ্গা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেই, প্রাণভয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ শুদ্ধি অভিযানের নামে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান বর্বরতার বিচার করবে কে- এ প্রশ্নটি এখন সর্বত্র মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এবং বিভিন্ন মানবাধিকার ও সাহায্য সংস্থার সকল আবেদন-নিবেদন উপেক্ষা করে মিয়ানমারের সাবেক সামরিক জান্তার সরকার থেকে বর্তমান আউং সান সুচির গণতান্ত্রিক সরকার একই কায়দায় রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত কায়দায় নিপীড়ন-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। সে দেশের রাখাইন প্রদেশে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। ইতোমধ্যে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। হত্যা, ধর্ষণের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। কেননা, রাখাইন প্রদেশে সে দেশেরসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও বিভিন্নভাবে আইওএম (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন), ইউএনএইচসিআরসহ (ইউনাইটেড নেশন হাইকমিশন ফর রিফিউজি) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত ৯ অক্টোবর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত রাখাইন প্রদেশের উত্তর মংডুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ৩৪ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারাসহ হত্যা করা হয়েছে প্রায় ১৮০ জনকে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছে তিন শতাধিক। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ৫শ’ জনকে। এমনিতর পরিস্থিতিতে আজ বুধবার কক্সবাজারের একটি হোটেলে বাংলাদেশের বিজিবি ও মিয়ানমারের বিজিপি কর্মকর্তা পর্যায়ের দিনব্যাপী একটি পতাকা বৈঠক হচ্ছে। উভয়পক্ষের ২৫ জন করে সদস্য বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে বিজিবির ইস্টার্ন জোনের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরিদ হাসান এবং বিজিপির পক্ষে কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার থেয়া থেনরুইন নেতৃত্ব দেবেন। বৈঠকটি ইতোপূর্বেই নির্ধারিত ছিল। তবে রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বৈঠকে আলোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিজিবি সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। তবে অফিসিয়ালি বৈঠকের এজেন্ডা রয়েছে পাঁচটি। এ পাঁচ এজেন্ডায় কী কী রয়েছে তা প্রচারমাধ্যমকে জানানো হয়নি। উল্লেখ্য, গত ৯ অক্টোবর সীমান্তের ওপারে সীমান্ত চৌকিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় লুটপাট হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং প্রাণ হারায় সে দেশের ৯ পুলিশ। এ ঘটনার পরদিন থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রাখাইন প্রদেশজুড়ে চলছে চিরুনি অভিযান। এ অভিযানের আধিক্যতা চলছে উত্তর মংডু এলাকাজুড়ে, যেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ঘনবসতি রয়েছে। সে দেশের সরকারসহ সেনাবাহিনীর দাবি, তারা জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। এ প্রসঙ্গে তাদের দাবি, উগ্রপন্থী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীর যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে কারও কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বর্তমানে চিরুনি বা শুদ্ধি অভিযানের নামে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে যৌথ অভিযান চলছে তাতে সাধারণ ও অসহায় নর-নারী ও শিশুরা ক্রমাগতভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। বর্বরোচিত যে কায়দায় রোহিঙ্গাদের উৎপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে তাতে বিবেকবানরা শিউরে উঠছে। লোমহর্ষক এ চিত্র বিবিসি, আলজাজিরাসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ইতোমধ্যে কমবেশি প্রচার হওয়ার পরও জাতিসংঘসহ শক্তিশালী দেশসমূহের কোন কার্যকর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে মিয়ানারের বৌদ্ধ মৌলবাদীরাও হামলে পড়ছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর। এতে চাপ পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। আইওএম’র পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, নতুন করে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। অপরদিকে, ইউএনএইচসিআর বলেছে, প্রায় ৪০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি হারিয়েছে। এরা বর্তমানে বন-জঙ্গলে, সাগরকূলে ও সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমার-বাংলাদেশের সীমান্তের নাফ নদীর ওপারে দলে দলে রোহিঙ্গাদের ভিড় জমেছে। প্রতি রাতেই সীমান্ত গলিয়ে এরা বাংলাদেশে চলে আসছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসার পর বিজিবির হাতে আটক হয়েছে ৬৬ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে রয়েছে ১১ পুরুষ, ২০ নারী ও ৩৫ শিশু। ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জনকণ্ঠকে জানান, আটক ৬৬ মিয়ানমার নাগরিককে মানবিক দিক দিয়ে খাবার ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে মঙ্গলবার বিকেলেই তাদের দেশে অর্থাৎ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাখাইন প্রদেশ মংডুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা সে দেশের নীতিনির্ধারক মহলের নতুন একটি কৌশল। গত রবি ও সোমবার ৩৪ রোহিঙ্গাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে সেনা সদস্যরা। উল্লেখ্য, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রাখাইন প্রদেশে গত ১০ অক্টোবর থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর অব্যাহত অভিযানে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, যুবতী-কিশোরীদের ধর্ষণ, তাদের বসতগৃহে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটপাট অব্যাহত রয়েছে। এতদিন গুলি ও জবাই করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এখন চলছে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এসব ঘটনা ঘটছে। গত সোমবার বিকেলে মংডুর উত্তর এলাকার দিনটি গ্রামের অন্তত শতাধিক বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেনা সদস্যদের দেয়া আগুনে এ পর্যন্ত ভস্মীভূত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি বাড়িঘর। যদিও মিয়ানমার সরকার এসব তথ্য অস্বীকার করে বলছে, মাত্র ৭০ জন রোহিঙ্গা নিহত এবং গ্রেফতার করা হয়েছে চার শতাধিককে। ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামের অভিযানে নিহতদের সবাই অস্ত্রধারী বিদ্রোহী বলে দাবি করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। যদিও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিহতের সংখ্যা আরও বেশি। এ কারণেই সেনা অভিযানে তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে শত শত রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গার মধ্যে বিপুলসংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে। বিজিবির নজরদারি কঠোর করা হলেও বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে। অনুপ্রবেশকারী মরিয়ম খাতুন নামে এক মহিলা জানায়, গুলি করলেও রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। তাই রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মেরে ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে, মিয়ানমারের রাইম্যাবিল এলাকা হতে ১৬ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বোঝাই একটি নৌকা বাংলাদেশের জাদিমুড়া ঘাটে আসার সময় হঠাৎ মাঝপথে নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় নৌকায় থাকা বয়স্ক নারী-পুরুষরা ডুবন্ত নৌকা ধরে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করে। এতে কয়েকজন রক্ষা পেলেও শিশুসহ আটজন এখনও নিখোঁজ। নিখোঁজরা হলো- আনোয়ার ইব্রাহীম, আফসানা, মোঃ ইমরান, সাজেদ হোসাইন ও এক যুবকসহ তিন মহিলা। স্বজন হারানো রোহিঙ্গা হুমায়ুন কবির ও রোকেয়া বলেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে প্রাণ রক্ষায় বাংলাদেশে চলে আসার সময় নদীতে নৌকাটি দুঘর্টনার কবলে পড়ে। আমাদের পরিবারের তিন সন্তানসহ ৮ জন নিখোঁজ রয়েছে। টেকনাফ থানার এসআই মাসুদ মুন্সী জানান, টেকনাফ সদরের নাজিরপাড়ার নাফ নদীর উপকূলে ভাসমান এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ওসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে উল্লেখ করে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের অভিবাসী বলে দাবি করে দেশটির সরকার এদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করতে পর্যায়ক্রমে এ পর্যন্ত ১৮ বার হামলা চালিয়েছে। এদিকে, সোমবার হ্নীলা চৌধুরীপাড়ায় রাখাইন অশোক বৌদ্ধবিহারে পুলিশ দলকে টহল দিতে দেখা গেছে। উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্ব স্ব এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান কমিটি গঠন করে বৌদ্ধবিহারগুলোতে পাহারা বসাতে বলা হয়েছে। টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল মজিদ জানান, অনাকাক্সিক্ষত যে কোন ধরনের ঘটনা এড়াতে পুলিশী টহল জোরদার করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছে বৌদ্ধবিহারে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শফিউল আলম, ওসি আব্দুল মজিদ রাখাইনপল্লী পরিদর্শন ও বসতিদের অভয় দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে। ১২ জেলেকে ফেরত দেয়নি মিয়ানমার ॥ চলতি মাসের ৩, ৯ ও ১১ তারিখে তিন দফায় ধরে নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশী ১২ জেলেকে এখনও ফেরত দেয়নি মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। বিজিবি বলছে, আটক জেলেদের ফিরিয়ে আনতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ অব্যাহত রয়েছে। টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ১০ হাজারের বেশি জেলে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের সেন্ট মার্টিন উপকূলে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সীমান্তে স্বাভাবিক অবস্থা ॥ মিয়ানমারে সহিংসতা চললেও বাংলাদেশ সীমান্ত স্বাভাবিক রয়েছে। কক্সবাজার থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা রয়েছে ১৩৪ কিলোমিটার। তন্মধ্যে স্থলসীমান্ত হচ্ছে ৮০ কিলোমিটার ও জলসীমান্ত রয়েছে ৫৪ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আতঙ্ক বা কোন ধরনের সমস্যা নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা আটক ॥ মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার বুচিদং গ্রামের বাটু মিয়ার পুত্র মোঃ ইদ্রিছকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করেছে কক্সবাজার থানা পুলিশ। সপ্তাহখানেক আগে চিকিৎসা নিতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হয় এ রোহিঙ্গা যুবক। আটক ইদ্রিছ জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে তাণ্ডব চালানোর সময় তার পায়ে গুলি লাগে।
×