ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা তালিকায় দেড় সহস্রাধিক

গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত নারী জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত নারী জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশে জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, নব্য জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল্লাহর দলসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের দেড় সহস্রাধিক নারী জঙ্গীর তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। তালিকাভুক্ত নারী জঙ্গীদের মধ্যে ১০৫ নারী জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নামে নারী জঙ্গীদের দিয়ে সদস্য সংগ্রহ, অর্থ, অস্ত্র সরবরাহ ও তথ্য বিনিময়ের কাজে ব্যবহার করছে পুরুষ জঙ্গীরা। পুরুষ জঙ্গীদের সহযোগী হিসেবে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে নারী জঙ্গীদের। দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত করে গড়ে তোলা হয়েছে নারী জঙ্গীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গীবিরোধী অভিযান চালানোর পর সেই জঙ্গী আস্তানা জাহাজ বাড়ির ৫ তলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নারীদেরও আসা-যাওয়া ছিল বলে তথ্য পাচ্ছে গোয়েন্দারা। ওই বাসায় মাঝে মধ্যে পর্দানশীন নারীদের আসতে দেখা গেছে। তবে তারা কখনই আশপাশের ফ্ল্যাটের কারও সঙ্গে কথা বলত না, কারও সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলেও কোন প্রশ্নের উত্তর দিত না। ওই বাড়িতে গত কয়েক মাস আগেও নারীদের মেস ছিল। পুলিশ অভিযানের পর জানা যায়, কল্যাণপুরে সেই বাড়ির ১৪টি রুমের ৫ তলা ছিল জঙ্গীদের অস্ত্র, অর্থ, গোলাবারুদ সংরক্ষণের ভার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এভাবেই চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও ঝিনাইদহসহ জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, রাজধানীর আজিমপুরের একটি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশ। ওই আস্তানা থেকে গুলশান হামলার আরেক মাস্টারমাইন্ড শীর্ষ জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি ও তানভীর কাদেরি ওরফে আবদুল করিমের স্ত্রী আবিদা তুল ফাতিমা এবং বাসারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিনকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়। যারা নিউ জেএমবির নারী শাখার অন্যতম জঙ্গী নেত্রী। এছাড়া আস্তানাটি থেকে পালিয়ে যায় অপারেশন রূপনগরে নিহত জঙ্গী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা। তাদের গ্রেফতারের পরই জানা যায় জঙ্গী সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। নব্য জেএমবির আবির্ভাবের পর থেকে নতুন করে তৎপরতা শুরু করে নারী জঙ্গীরা। উচ্চশিক্ষিত এই নারীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তাদের কর্মকা- পরিচালনার জন্য। এরই মধ্যে তাদের অনেকেই মানসিকতা ও কর্মকা-ে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। গোপনে নিচ্ছে অস্ত্র চালনা ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ। জঙ্গী দল ভারী করতে অনেক পুরুষ জঙ্গী একাধিক বিয়ে করে থাকেন। বিয়ের পর স্ত্রীদের ধীরে ধীরে নারী জঙ্গী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করতে বাধ্য করেন পুরুষ জঙ্গীরা। গোয়েন্দা সূত্র জানান, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নতুন ধারার (নব্য জেএমবি) নেতারা অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমেই নারী সদস্যদের সংগ্রহ করছেন। অনলাইনে খোঁজ করে তারা ধর্মভীরু শিক্ষিত তরুণীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন। জঙ্গী মতাদর্শ গ্রহণের পর তারা নিজেদের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে নারী সদস্যদের জঙ্গী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দিচ্ছেন। মোবাইল ফোনে নির্দিষ্ট এ্যাপস ডাউনলোড করে কার্যক্রম পরিচালনা করার কৌশলও শেখানো হয়েছে নারী জঙ্গীদের। সম্প্রতি ঢাকা ও গাজীপুর থেকে গ্রেফতার চার তরুণীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গ্রেফতার নারী জঙ্গীদের দলে আরও অন্তত এক ডজন তরুণী আছে, যাদের মধ্যে ১০ জনের নাম পেয়েছে তারা। তারা হলো সাফিয়া ওরফে সানজিদা ওরফে ঝিনুক, মাইমুনা ওরফে মাহমুদা ওরফে লায়লা, তাসনুবা ওরফে তাহিরা, সায়লা ওরফে শাহিদা, সালেহা ওরফে পুতুল, দিনাত জাহান ওরফে নওমী ওরফে বানী, তানজিলা ওরফে মুন্নী, আলিয়া ওরফে তিন্নি ওরফে তিতলী, মনিরা জাহান ওরফে মিলি ও ছাবিহা ওরফে মিতু। এই সন্দেহভাজন নারী জঙ্গীদের খুঁজছে পুলিশ। ‘ইসলামী ক্লাস ফর গার্লস পেজ’ এবং ‘ব্লাড রোজ’ নামের ফ্যান পেজ থেকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করত তারা। যেসব তরুণী জঙ্গীদের ‘মতাদর্শ’ গ্রহণ করে, তাদের মোবাইল ফোনে কয়েকটি এ্যাপস সরবরাহ করা হয়। এগুলোর মধ্যে ‘উম্মা তাওহিদ’ ও ‘আনসার ইসলামিয়া’ উল্লেখযোগ্য। ‘উম্মু জনদুল্লাহ হুরাইয়া’র মাধ্যমে থ্রিমা এ্যাপ ও একিউআইএস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তারা। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষিত তরুণীদের দলে ভেড়ানোর পাশাপাশি অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, গত ২১ জুলাই জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলীয় আমির মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসানকে টঙ্গী থেকে গ্রেফতারের পর তার নারী জঙ্গী নেটওয়ার্কের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে সোমবার সকালে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঐশীকে এবং রাতে মিরপুর ১ নম্বরের জনতা হাউজিং এলাকা থেকে মৌসুমিকে গ্রেফতার করা হয়। একই রাতে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেঘলাকে গ্রেফতার করা হয়। ঐশী তিন বছর ধরে, মৌসুমি ও মেঘলা সাত মাস ধরে জিহাদী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। চার নারী জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর সন্ত্রাসবিরোধী যে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাতে আরও ১০ তরুণীর নাম উল্লেখ করা হয় যারা নারী জঙ্গী হিসেবে পরিচিত। গোয়েন্দা সূত্র বলছেন, জেএমবির শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আব্দুল আউয়ালের স্ত্রীরাও জঙ্গী তৎপরতায় যুক্ত ছিল। তাদের ফাঁসি হওয়ার পর কিছুদিন সংগঠনটির নারী ইউনিট চুপচাপ ছিল। এখন আবার তৎপরতা শুরু হয়েছে। নূরজাহান, মারজিয়া, মিনা আক্তার, লতা, শারমিন, জ্যোৎস্না ও বিলকিসদের দিয়ে নতুন করে গঠন করা হয়েছে মহিলা ইউনিট। তাদের সঙ্গে জেএমবির পলাতক শীর্ষ নেতাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, টঙ্গী, গাজীপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে নারী জঙ্গী বেশি। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে সংগঠনের সদস্য বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস থেকে জঙ্গী সন্দেহে লিপি আক্তার, নাজমা সুলতানা, নাসরিন সুলতানা ও নুরুন্নাহার নামে হিযবুত তাহরীরের চার মহিলা সদস্য র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, সারাদেশেই জেএমবিসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনে এখন রিক্রুট করা হচ্ছে নারীদের। তাদের কাছে এর একটা তালিকাও আছে। তাতে দেড় সহস্রাধিক সক্রিয় সদস্য থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হামলা চালানোর জন্য এদের ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে উগ্রবাদীদের। নারী জঙ্গীরা জেলা পর্যায়ে পাড়া-মহল্লায় ধর্ম প্রচারের নামে ও ছোট ছোট সাপ্তাহিক ধর্মসভার আড়ালে কাজ করছে। জঙ্গীবাদী তৎপরতায় মহিলাদের ব্যবহারের কিছু সুবিধা আছে। পর্দা করার কারণে এদের শনাক্ত করা কঠিন এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনও এদের জন্য সহজ। বিশেষ করে আত্মঘাতী হামলায় এদের ব্যবহারে বাড়তি সুবিধা পেতে পারে জঙ্গীরা। নারী জঙ্গী সৃষ্টিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে হিযবুত তাহরীর। নিষিদ্ধ এ জঙ্গী সংগঠনের ছাত্রী মুক্তি সংস্থা নামে একটি শাখা আছে। এর বাইরে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল্লাহর দলসহ প্রতিটি জঙ্গী সংগঠনের আলাদা নারী ইউনিট রয়েছে। অনেক দিন ধরেই জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ-হুজি, এবিটি ও হিযবুত তাহরীরের নারী সদস্যরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়।
×