ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

তৃতীয় অধ্যায় ॥ বাগেরহাটে এক বছর (গতকালের পর) আমি তাকে বললাম যে, আমি মদ্যপান করি না। তখন তিনি একটু আশ্চর্য চোখে আমার দিকে তাকালেন এবং মন্তব্য করলেন যে, মড়ড়ফ যধনরঃ। অতঃপর আমাকে বিদায় দিলেন এবং জানালেন যে, ভোর সকালে তার জাহাজ নোঙর উঠাবে এবং সেজন্য তাকে বিদায় দিতে আমাকে যেতে হবে না। ট্রেনার সাহেব তার এই পরিদর্শনের নিদর্শন কোথাও রেখে গেলেন না। তিনি কোন জায়গায়ই, কোন দফতরে কিছু লিখলেন না এবং তার মূল দফতরে ফিরে গিয়ে কখনও এক লাইনের প্রতিবেদনও পাঠালেন না। কিছুদিন পরেই আইয়ুব খান যে বহু সরকারী কর্মচারীকে চাকরি থেকে অবসর এবং বিতাড়িত করলেন সেই চক্করে এই কর্মকর্তাও অবসর নিয়ে বিদায় হলেন। একদিন বেশ রাত পর্যন্ত নিউজপ্রিন্টের কর্মচারী সেই যুবকটির সঙ্গে গল্প করছিলাম। সেদিন গ্রীষ্মের অত্যাচার ছিল প্রকট ও কি রকম একটি গুমোট আবহাওয়া ছিল। হঠাৎ আমার পোষা হরিণ দুটি ছোটাছুটি শুরু করল এবং প্রথমবারের মতো আওয়াজ দিল। এই দুটো হরিণ ছানাকে আমি সুন্দরবনে এক ভ্রমণকালে পাই। আমার মোটরবোটের শব্দে কোন শিকারি এদের মাকে মেরে সরে পড়ে। অসহায় দুটো হরিণছানা কেমন যেন ভয় ও অনিশ্চয়তায় পতিত হয়। আমর সঙ্গী লোকজন তাদের ধরে আমার লঞ্চে নিয়ে আসে। তখন থেকেই তারা আমার হরিণ হয়ে যায়। বাগেরহাট থেকে আমার বদলি হলে আমি সেগুলোকে সিলেটে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। সেখানে তারা মনের আনন্দে বড় হতে থাকে। তাদের ভাগ্য শেষ পর্যন্ত এমন সুপ্রসন্ন ছিল না। তাদের একটি (মাদীটি) আমাদের সিলেটের বাড়িতে অকস্মাৎ ঝাঁপাঝাঁপি করে আঘাত পেয়ে মারা যায়। অতঃপর তার সঙ্গীটি বিরাট শিংওয়ালা হরিণ হিসেবে বেড়ে উঠে, তার জন্য সঙ্গী পাওয়া সিলেটে সম্ভব ছিল না। তাই প্রজনন মওসুমে হরিণটি প্রায় উন্মত্ত হয়ে হিং¯্র হয়ে যেত। তাকে শুধু আমার আব্বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। একদিন সে তার আশ্রয়স্থলে আমার আব্বাকেও আঘাত করে বসল। এমতাবস্থায় তাকে জবাই করতে হয়। আমি কোনমতেই তার গায়ে গুলি ছুড়তে পারলাম না। তখন আমার ভাই সুজন সেই কাজটি করে এবং আহত হরিণটিকে তখন জবাই করা হয়। তখন হরিণটির বয়স হয়েছিল প্রায় তিন বছর। যাই হোক হরিণ ছানাদের আওয়াজ শুনে ভেতর বাগানে গেলে দেখতে পেলাম যে, একটি বিরাট কেউটে সাপ তাদের তাড়া করছে। আমি তখনই আমার বন্দুক নিয়ে সাপটিকে গুলি করলাম। আমি জানতাম যে, সাপের গায়ে গুলি লাগলেই সেটা আর নড়াচড়া করতে পারে না। সাপটিকে আমরা লাঠি মেরে হত্যা করলাম এবং পরদিন সকালে সাপুড়েরা এসে সেটি নিয়ে যায়। মার্শাল ’ল জারির অব্যবহিত পরেই আমি বাগেরহাটে পদায়িত হই। সে কারণে বাগেরহাটের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতে অনেক সময় লাগে। আমি তখন প্রায় আট মাস কাটিয়েছি যখন একজন আইনজীবী আমাকে বললেন যে, মুসলিম লীগ নেতা আবদুস সবুর আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। এ নিয়ে কোন প্রচার চান না এবং এজন্য তিনি চুপচাপ আমার সঙ্গে দেখা করবেন। নির্দিষ্ট দিনে তিনি এসে যোগাযোগ বিভাগের একটি ইন্সপেকশন বাংলোয় থাকলেন এবং এক সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসলেন। তার বাড়ি মূলঘরে। অবশ্যি তিনি বসবাস করতেন খুলনায়। তিনি বললেন, কোন দাবি বা অভিযোগ নিয়ে আসেননি। তিনি এসেছেন আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে ও সহায়তা করতে। তার এলাকার জন্য আমি অনেক কিছু করছি, তাই তিনি আমার কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি আরো বললেন, তার নিজস্ব এলাকা মূলঘরে টিউবওয়েল বসানো বা খেলার মাঠ উন্নয়ন এসব কাজে তিনি সহায়তা করতে চান। তাকে বললে তিনিই এসব তার খরচেই করে দেবেন। মূলঘরে একটি খেলার মাঠ উন্নয়নে এবং আরো কোনখানে একটি টিউবওয়েল বসানোর ব্যবস্থা তার খরচেই সম্পাদিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা, পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী আবদুল আজিজও একদিন এসে আমাকে তার এলাকায় ভাল কাজ করছি বলে ধন্যবাদ জানালেন এবং তার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত করলেন। তার বিয়ে হয় ঢাকায়। আমি তার বিয়েতে বরযাত্রী ছিলাম। আটটাকার যুবনেতা আলি আহমদ (সদ্য প্রয়াত) তখন অবিবাহিত ছিলেন। তিনিই প্রথম রাজনীতিবিদ যিনি আমাকে প্রকাশ্যে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে অংশ নিয়ে চেয়ারম্যান হন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে আমার সহযোগী হন। পরবর্তীকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হন। তার সঙ্গে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়, যার অবসান হয় তার মৃত্যুকালে। তার স্ত্রী বর্তমানে একজন সংসদ সদস্য। বাসাবাটির জমিদার নাগ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয় বাগেরহাটে আমার অবস্থিতির প্রায় ৪/৫ মাস পরে। সেই বাড়ির এক জমিদার মাতা আমাকে তার বাড়িতে আহ্বান করলেন। তিনি বললেন, তাদের সম্পত্তিটি তখন সব দূর সম্পর্কের গরীব আত্মীয় ও কর্মচারীদের বসতি হিসেবে আছে। তিনি চান যে, সম্পত্তিটি সুরক্ষিত হোক। সেজন্য তিনি আমাকে বলেন, আমি যদি সম্পত্তিটি হুকুম দখল করে নিয়ে কোন সরকারী দফতর স্থাপন করি তাহলে তিনি খুব খুশি হবেন। তিনি তার বাড়িতে সুরক্ষিত চিত্রশিল্পী রবি বার্মার আঁকা শকুন্তলার একটি আলোকচিত্র আমাকে প্রদান করে বলেন, ছবিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাকে তিনি উপদেশ দেন এটি মাউন্ট করে অতিসত্বর যেন তার সুরক্ষা করি। ছবিটি আমি সযতনে এখনো টানিয়ে রাখি। তার সম্পত্তিও আমি হুকুম দখল করে সেখানে মহকুমা রাজস্ব দফতর স্থাপন করি। এছাড়া জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে আমি শিশু বিদ্যালয় নামে একটি প্রাথমিক স্কুলও স্থাপন করি। আগেই বলেছি যে, বাগেরহাটের যেসব এলাকায় কোন ধরনের পায়ে চলা পথ ছিল সেখানে আমার আনাগোনা ছিল ব্যাপক। আমার একটি সাইকেল ছিল এবং আমি তখন শার্ট বা স্পোর্টস গেঞ্জি পরে বিভূষিত হয়ে অনেক ঘুরে বেড়াতাম। আমার জমাদারও আর একটি সাইকেল নিয়ে আমার সহযাত্রী হতো। চলবে...
×